স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের চাকরির মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। তিনি এখনো মহাপরিচালক। কারণ, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে তাঁর চাকরির মেয়াদ একাধিকবার বাড়ানো হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে চুক্তি শেষ হবে আসছে ডিসেম্বরে।
অন্তর্বর্তী সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সব বাতিল হবে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমকে মহাপরিচালকের পদ হারাতে হবে। শুধু তিনি নন, স্বাস্থ্য বিভাগের আরও বেশ কয়েকজনকে সরে যেতে হবে। তাঁরা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে থাকায় উপযুক্ত অনেকেই শীর্ষ পদে যেতে পারেননি। অনেকে অবসরে গেছেন।
আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন শল্যচিকিৎসক। শিক্ষক হিসেবে তাঁর সুনাম আছে। চিকিৎসা পেশার বাইরে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হিসেবে তাঁর পরিচিতি আছে। তবে স্বাস্থ্য প্রশাসনের বড় পদে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। করোনা মহামারির শুরুর দিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ হঠাৎ চলে যাওয়ার পর সেই পদে বসেন আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। পরে জানা যায়, আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ছিলেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের চিকিৎসক। গত বছর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে জাহিদ মালেক বলেছিলেন, তাঁর অস্ত্রোপচার হয়েছিল আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের হাতে।
নিয়মিত সময়ের পর আবুল কালাম আজাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে একাধিক অতিরিক্ত মহাপরিচালক সর্বোচ্চ পদে বসতে পারেননি। তাঁরা অবসরে চলে যান। এখন আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা চলছে।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে নিয়মিত চাকরি শেষ হওয়ার পর আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের চাকরি দীর্ঘায়িত হয় চুক্তির কারণে। এখনো তিনি চুক্তিতে আছেন। তাঁর সময়ে স্বাস্থ্য বিভাগের নিময়শৃঙ্খলা সবচেয়ে নিম্ন পর্যায়ে এসেছে বলে অভিযোগ আছে। একাধিকবার মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে এবারও একাধিক কর্মকর্তা অবসরে যান মহাপরিচালকের পদে বসার আগেই।
এ ঘটনা শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ঘটছে, তা–ই নয়। ন্যাশনাল নিউরোসায়েন্সেস ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক কাজী দীন মোহাম্মদের ক্ষেত্রেও এমনটি দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে ১০ বছর আগে অর্থাৎ ২০১৪ সালে কাজী দীন মোহাম্মদের সরকারি চাকরিজীবনের সময়সীমা শেষ হয়। কিন্তু তিনি এখনো সরকারি চাকরি করে চলেছেন। তাঁর উপস্থিতির কারণে পরিচালকের পদে আর কেউ বসতে পারছেন না।
নিউরোসায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের কাছেই জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট। এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা। তাঁর সরকারি চাকরির বয়স শেষ হয়েছে ২০১৭ সালে, তবে চাকরি শেষ হচ্ছে না। চুক্তি হচ্ছে, চাকরির মেয়াদ বাড়ছে। অন্যরা হতাশ হয়ে সরকারি চাকরি শেষ করছেন।
একই ঘটনা দেখা যায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের ক্ষেত্রে। কলেজটির অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ বি এম মাকসুদুল হকের ক্ষেত্রে। তাঁর সরকারি চাকরির বয়স শেষ হয়েছে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে। কিন্তু তাঁকেও রেখে দেওয়া হয়েছে চুক্তি করে। যোগ্য একাধিক অধ্যাপক থাকা সত্ত্বেও তাঁদের অধ্যক্ষ করা হয়নি।
এ রকম উদাহরণ আরও আছে। জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মীর জামাল উদ্দিন, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আব্দুল কাদের, সিরাজগঞ্জের এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আমিরুল হোসেন চৌধুরী, মানিকগঞ্জের কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন কাজ করছেন চুক্তি ভিত্তিতে। অধ্যাপক নুরুল হুদা লেনিন তাঁর চাকরিজীবন শেষ করেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে। কিন্তু তাঁকেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) পরিচালক পদে। তাঁরা কেউ এক, কেউ দুই বা কেউ তিন বছরের চুক্তিতে আছেন।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে এসব প্রতিষ্ঠান বা কলেজের উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি বা পরিবর্তন হয়েছে এমন নজির বিরল; বরং এই প্রবণতা স্বাস্থ্য খাতকে দুর্বল করেছে বলে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছেন।
এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে বঞ্চিত হয় পদের অধিকারী উপযুক্ত ব্যক্তি। এতে অনেকেই কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত সঠিক। এই সিদ্ধান্ত ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে স্বাস্থ্য খাতে।