১০০ মিটার দূরে মিয়ানমার সীমান্ত। এপারে ধানের চারা রোপণে ব্যস্ত কয়েকজন কৃষক। তাঁদের একজন খাইরুল আমিন (৪০)। গতকাল বুধবার দুপুরে তিনি বলছিলেন, ‘রোববার থেকে খেতের আশপাশে আসতে পারিনি। মঙ্গল ও বুধবার (গতকাল) গোলাগুলি ও মর্টার শেলের আওয়াজ পাইনি। এ জন্য দুপুরের পরে ধানের চারা রোপণের কাজ করছি। আজকালের মধ্যে চারা রোপণ করতে না পারলে নষ্ট হয়ে যাবে।’
খাইরুল আমিন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের পূর্ব–পশ্চিম কূলের বাসিন্দা। পশ্চিম কূল গ্রাম থেকে মিয়ানমারের তুমব্রু রাইট ক্যাম্প দেখা যায়। গত রোববার এই ক্যাম্প দখলকে ঘিরে গোলাগুলি শুরু হয়। খাইরুল আমিন জানান, গোলাগুলি কমলেও এখনো ভয়ে আছেন তাঁরা।
কক্সবাজারের উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষেরা দিনের বেলা ঘরে থাকলেও রাত কাটাচ্ছেন দূরে আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন স্কুলে।
সীমান্তবর্তী স্কুলগুলোয় অনুপস্থিত থাকছে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। শিক্ষক ও অভিভাবকেরা বলছেন, গোলাগুলির ভয়ে তারা বিদ্যালয়ে আসছে না।
মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮৩ কিলোমিটার। এর বড় একটা অংশই পড়েছে কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়। সীমান্তের এসব এলাকায় লাখের কাছাকাছি বাসিন্দা রয়েছেন।
এদিকে গতকাল আরাকান আর্মিসহ বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হামলার মুখে নতুন করে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সামরিক কমান্ডারসহ ৬৪ জন টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যং সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন ৩২৮ জন মিয়ানমারের নাগরিক। এর মধ্যে বিজিপি সদস্যের পাশাপাশি সে দেশের সেনা কর্মকর্তা, শুল্ক কর্মকর্তাও রয়েছেন।
অপরদিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেছেন, সীমান্তে যেকোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাঁরা তৎপর রয়েছেন। গতকাল সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।
শুক্রবার রাত থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বিজিপির সংঘর্ষ চলছে। ইতিমধ্যে বিজিপিকে হটিয়ে তুমব্রু রাইট ক্যাম্প ও ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি আরাকান আর্মি দখলে নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। রোববার দিবাগত রাত তিনটা থেকে দুই পক্ষের মধ্যে থেমে থেমে গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। সোমবার নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামের একটি রান্নাঘরের ওপর মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহত হন। নিহত দুজনের মধ্যে একজন বাংলাদেশি নারী, অন্যজন রোহিঙ্গা পুরুষ।
গতকাল বেলা একটার দিকে উখিয়ার রহমতের বিল সীমান্ত এলাকায় গেলে শোনা যায় গুলির শব্দ। স্থানীয় বাসিন্দা ফজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মঙ্গলবার রাত আটটা থেকে নয়টা পর্যন্ত তাঁরা গুলির শব্দ পেয়েছেন। পরদিন সকালে (আজ) কয়েকটি গুলির শব্দ পান। কয়েক ঘণ্টা পরপর গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। তবে তা মঙ্গলবারের তুলনায় কম।
ফজলুর রহমান বলেন, তাঁদের প্রতিবেশী নুরুল আমিন, আবু রাশেদ, মৌলভী সুলতান, কাদের বক্সসহ ৫০টি পরিবার রাতের বেলা ঘরে থাকছে না। তাঁরা বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে উঠেছেন।
একই অবস্থা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্ত এলাকায়। ঘুমধুমের উত্তরপাড়া এলাকার বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন (৬৭) প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের এলাকার প্রায় ২৫০ পরিবার ঘরছাড়া। পুরো পাড়ায় এক থেকে দুজন করে পুরুষ সদস্য রয়েছেন বাড়ি পাহারা দিতে, যাতে চুরি–ডাকাতি না হয়।
উখিয়ার রহমতের বিল সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা গতকাল দুপুরে অভিযোগ করেন, গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর থেকে টহল কমে গেছে। তবে বিজিবির দুই সদস্য বলেছেন, তাঁরা টহল বাড়িয়েছেন।
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকার ছয়টি স্কুলে আতঙ্কে শিক্ষার্থীরা আসছে না। গতকাল দুপুরে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, একজন শিক্ষার্থীও নেই। প্রধান শিক্ষকসহ কয়েকজন শিক্ষক বসে আছেন। এই বিদ্যালয় থেকে আধা কিলোমিটার দূরে মিয়ানমারের ঢেঁকিবুনিয়া সীমান্ত। সীমান্ত ও বিদ্যালয়ের মাঝখানে বাড়িঘর নেই। গতকাল বিদ্যালয়ে অবস্থানকালে মিয়ানমার থেকে গুলি ছোড়ার শব্দ শোনা গেছে।
একই অবস্থা বালুখালী লতিফুন্নেছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বালুখালী সীমান্ত থেকে আধা কিলোমিটার দূরে বিদ্যালয়টির অবস্থান। অপর দিকে বালুখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ ইউনুস গতকাল জানান, তাঁদের বিদ্যালয়ের পাশে ধানখেতে মঙ্গলবার একটি গুলি এসে পড়ে।
পাঁচজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানিয়েছেন, এত ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারবেন না। আগে বাঁচতে হবে।
তবে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু-ঘুমধুম সীমান্তঘেঁষা সাতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গতকাল বুধবার পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ত্রিরতন চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এসব বিদ্যালয় বন্ধ থাকবে।
গতকাল আসা মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের নিরস্ত্র করে টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যং এলাকায় বিজিবির সীমান্ত ফাঁড়িতে আনা হয়। দুপুরে টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যং সীমান্ত দিয়ে তারা দেশে ঢুকে পড়ে।
গতকাল বেলা দেড়টার দিকে হোয়াইক্ষ্যং সীমান্ত ফাঁড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায়, আশপাশে শত শত লোকজনের ভিড়। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সেক্টর কমান্ডারকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে বসানো হয়েছে। কারণ জানতে চাইলে বিজিবির এক সদস্য সাংবাদিকদের বলেন, ‘উনি মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সেক্টর কমান্ডার।’
মিয়ানমার বর্ডার গার্ড সদস্যদের বেশ কয়েকজনের গায়ে ইউনিফর্ম রয়েছে। আরও কয়েকজন রয়েছেন হাফপ্যান্ট পরা। বেশির ভাগেরই হাতে–পায়ে কাদা।
এ সময় স্থানীয় বাসিন্দা হাফিজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর লোকজন ঢুকে পড়ায় যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাঁরা যাতে ঢুকতে না পারেন, সে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের আশ্রিত ব্যক্তিদের মধ্যে দুজন নারী ও দুটি শিশু আছে জানিয়ে বিজিবিপ্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, ‘তাদের নিরাপত্তাটুকু নিশ্চিত করার দায়িত্ব, মানবিক কারণে এবং আন্তর্জাতিক রীতি ও সুসম্পর্ক রাখার কারণে আমরা করছি।’
১০ ফেব্রুয়ারি শনিবার থেকে নিরাপত্তাজনিত বিষয়ে টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনগামী সব পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আদনান চৌধুরী গতকাল গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।