সম্ভাবনার পরও গ্যাস অনুসন্ধানে জোর কম

বছরে গড়ে একটি অনুসন্ধান কূপ হয়নি। সমুদ্রে খনন হয়নি একটি কূপও। আমদানিনির্ভরতায় ঝুঁকছে জ্বালানি খাত।

বিভিন্ন সময় বিদেশি পরামর্শকেরা স্থলভাগে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন। বঙ্গোপসাগরেও দ্বিমাত্রিক জরিপ করে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখিয়েছে একাধিক বিদেশি কোম্পানি। এত সম্ভাবনা থাকার পরও দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে তৎপরতা কম। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় অনুসন্ধান কূপ খননকে, যেখানে পিছিয়ে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) ও গ্যাস অনুসন্ধানসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯১০ সালে প্রথম অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয় বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। এখন পর্যন্ত ১১২ বছরে মোট ৯৬টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ৫৩ বছরে হয়েছে ৪১টি। গ্যাসক্ষেত্র থাকা কোনো দেশে বছরে গড়ে একটির কম অনুসন্ধান কূপ খনন করার ঘটনা আর কোথাও নেই।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তথ্য বলছে, ২০০৯ পর্যন্ত ৭৭টি অনুসন্ধান কূপ খনন করে ২৩টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০২ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত মাত্র দুটি কূপ খনন হয়।

এরপর গত ১৩ বছরে আরও ১৯টি অনুসন্ধান কূপ খনন করে পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গেছে। তার মানে গড়ে সাড়ে তিনটি কূপ খনন করে একটি গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গেছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিকভাবে প্রতি পাঁচটি অনুসন্ধান কূপের বিপরীতে একটিতে গ্যাস পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এর চেয়ে ভালো ফল পাওয়ার পরও গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেওয়া হয়নি।

উচ্চ দামে গ্যাস আমদানি না করে দেশে উৎপাদন বাড়াতে সর্বোচ্চ জোর দেওয়া হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ১৭টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হবে। এ ছাড়া নতুন পিএসসি তৈরি করা হচ্ছে।
নাজমুল আহসান, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান

ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস পাওয়া গেছে, এমন দেশের তালিকায় সবচেয়ে কম অনুসন্ধান কূপ খনন করা দেশটি বাংলাদেশ। যথাযথ অনুসন্ধান করা হলে আজকের সংকটে পড়তে হতো না। বাংলাদেশ অনুসন্ধানে জোর না দিয়ে গ্যাস আমদানির দিকে ঝুঁকেছে।

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, প্রতিবেশী ত্রিপুরা রাজ্য আকারে ছোট হলেও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে। ভারতের রাষ্ট্রীয় গ্যাস কোম্পানি ওএনজিসির তথ্য বলছে, ত্রিপুরা রাজ্যটি ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার। তারা এখন পর্যন্ত ১৭০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে। অথচ এর চেয়ে ১৪ গুণ বেশি আয়তনের দেশ হয়েও অনেক কম অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে বাংলাদেশ।

আজ জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস। ২০১০ সাল থেকে সরকারিভাবে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেল ওয়েল কোম্পানির কাছ থেকে ৪৫ লাখ পাউন্ড স্টার্লিংয়ে (তখনকার ১৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা) পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র কিনে নেন।

এই গ্যাসক্ষেত্রগুলো জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তার বড় নির্ভরস্থল হয়ে ওঠে। এবারের জ্বালানি দিবসের প্রতিপাদ্য—‘বহুমুখী জ্বালানি, সমৃদ্ধ আগামী’। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে, জ্বালানি নিশ্চিত না করেই। বরং প্রতিবছর জ্বালানি আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, আগের বছরের তুলনায় গত অর্থবছরে জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১১৬ শতাংশ।

নিজস্ব সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে আমদানির ঝুঁকি কমিয়ে আনা যায়। যত সময় লাগুক, গ্যাস অনুসন্ধান করতেই হবে। একক জ্বালানি উৎসের ওপর নির্ভর করা যাবে না।
ম তামিম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী

বছরে গড়ে চারটি কূপ খননের পরিকল্পনা

জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, ২০১০ সাল থেকে সরকার গ্যাস খাতে গুরুত্ব দিয়ে একের পর এক অনুসন্ধান কূপ খনন শুরু করে। ২০১১ সালে আবিষ্কৃত হয় নোয়াখালীর সুন্দলপুর। ২০১২ সালে পাওয়া গেছে কুমিল্লার শ্রীকাইল। এ দুটি থেকে গ্যাস তোলা হচ্ছে। ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ছোট একটি গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গেছে। এক বিলিয়ন ঘনফুট তোলার পর এটি বন্ধ হয়ে গেছে। ২০১৮ সালে আবিষ্কৃত ভোলার ভেদুরিয়া গ্যাসক্ষেত্র থেকে এখনো উৎপাদন শুরু হয়নি। গত বছরের আগস্টে সর্বশেষ আবিষ্কৃত হয় জকিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র, যা তোলা শুরু হয়নি।

এদিকে বঙ্গোপসাগরে অনুসন্ধান শুরু হয় ২০১০ সালে। ২০১২ সালে ভারত ও ২০১৪ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তি হয়। ২০১৪ সালে একটি বহুমাত্রিক জরিপ চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও আজ পর্যন্ত তা হয়নি। ইতিমধ্যেই সমুদ্রে গ্যাস আবিষ্কার করেছে মিয়ানমার ও ভারত। আর বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো অনুসন্ধান কূপ খনন করতে পারেনি। চারটি বিদেশি কোম্পানি এ পর্যন্ত কাজ শুরু করলেও তিনটি মাঝপথে চলে গেছে। ভারতের কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ আগামী ডিসেম্বরে একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

এখন নতুন করে উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি (পিএসসি) করতে একটি খসড়া তৈরি করা হচ্ছে। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান আশাবাদী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চ দামে গ্যাস আমদানি না করে দেশে উৎপাদন বাড়াতে সর্বোচ্চ জোর দেওয়া হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ১৭টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হবে। এ ছাড়া নতুন পিএসসি তৈরি করা হচ্ছে। আগামী বছরের শুরুতে বঙ্গোপসাগরের গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হবে।

দেশে মোট গ্যাসক্ষেত্র আছে ২৮টি। এর মধ্যে ২০টি থেকে বর্তমানে উৎপাদন করা হচ্ছে। গ্যাসের মোট মজুত ২৮ টিসিএফ। এর মধ্যে প্রায় ১৯ টিসিএফ উৎপাদন করা হয়েছে। মজুত বাকি আছে আর ৯ টিসিএফ। বছরে প্রায় ১ টিসিএফের মতো উৎপাদন করা হচ্ছে। এতে নতুন গ্যাস যুক্ত না হলে ২০২৫ সালের পর থেকে উৎপাদন অনেক কমে যাবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, নিজস্ব সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে আমদানির ঝুঁকি কমিয়ে আনা যায়। যত সময় লাগুক, গ্যাস অনুসন্ধান করতেই হবে। একক জ্বালানি উৎসের ওপর নির্ভর করা যাবে না। সবার মতামত নিয়ে একটি সমন্বিত জ্বালানিনীতি তৈরি করে এগোনো দরকার এখন।