হোলি আর্টিজানে হামলার ৭ বছর

নিভে যাওয়া রবি আলো ছড়াচ্ছে

ভাই রবিউল করিমের (ডানে) সঙ্গে শামসুজ্জামান
ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

রবিউল করিম। পরিবারের কাছে কামরুল আর বন্ধুমহল ও সহকর্মীদের কাছে রবি নামেই পরিচিত। এ রবিউলের জীবনপ্রদীপ নিভে যায় ২০১৬ সালের এই দিনে। দিনটি ছিল দায়িত্বের কাছে মায়ের প্রত্যাশা হার মানার। সেদিন মায়ের সঙ্গে ইফতার করার কথা ছিল ভাইয়ের। হ্যাঁ, রবিউল ভাই মায়ের কাছে এসেছিলেন, তবে এক দিন পর, গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে ক্ষতবিক্ষত নিথর দেহ নিয়ে।

আজ এই দিনে মা তাঁর সন্তান, ভাবি তাঁর স্বামী, ছোট্ট সাজিদুল করিম সামি ও কামরুন্নাহার রায়না তাঁর বাবা আর আমি হারিয়েছি ভাইকে। নৃশংস-বর্বরোচিত সেদিনের ঘটনায় সমগ্র বাঙালি জাতি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভাইকে হারানোর সেদিনের যন্ত্রণা আজ আমাদের কাছে গৌরবের।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত হওয়ার সময় রবি ভাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮১ সালের ৩০ নভেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার আটিগ্রাম ইউনিয়নের কাটিগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রবিউল করিম।

রবিউল ভাই আমাদের পথপ্রদর্শক, দিকনির্দেশনাকারী। তিনি আমাদের আদর্শ। জীবনের খুব অল্প সময়ে তিনি দেখিয়ে গেছেন, কীভাবে অবহেলিত মানুষের জন্য কাজ করা যায়, দেশ ও মানুষের কল্যাণে জীবন দিয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকা যায়। সবার আবেগ, ভালোবাসা ও সম্মানের জায়গায় নিজের সুদৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করা যায়। শহীদ রবিউলের জীবনপ্রদীপ নিভে গেলেও মানবতার এই ফেরিওয়ালা আজও আলো ছড়াচ্ছেন তাঁর কর্মের মধ্য দিয়ে। মূলত রবিউল ভাই শহীদ হওয়ার পর তাঁর জীবদ্দশায় করা কর্মগুলো জানতে শুরু করেন সবাই।

মানিকগঞ্জের পুলিশ লাইনসের মূল ফটকের পাশে রবিউল করিমের ম্যুরাল

ব্যক্তিজীবনে রবিউল ভাই ছিলেন খেয়ালি স্বভাবের স্বপ্নবাজ মানুষ। তাঁর খেয়ালি স্বভাব নিয়ে প্রায়ই চিন্তায় পড়ে যেতাম। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ করে জন্মস্থান কাটিগ্রামে ফিরে কৃষিকাজ শুরু করেন। গ্রামবাসী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছেলের কৃষিকাজটিকে ভালোভাবে নেননি। বিষয়টি নিয়ে মা-বাবাকে নানা নেতিবাচক মন্তব্য শুনতে হয়েছিল। ভাইয়ের যুক্তি ছিল, শিক্ষিত হয়ে সবাই যদি চাকরি খোঁজে, তাহলে কৃষক হবে কে? মাটি ও মানুষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে পছন্দ করতেন তিনি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া অসহায় মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, যন্ত্রণাকে নিজের চেতনায় আত্মস্থ করেছেন।

নিজ গ্রামে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য ব্লুমস বিশেষায়িত বিদ্যালয় এবং অন্য শিশুদের জন্য নজরুল বিদ্যা সিঁড়ি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে গেছেন রবিউল ভাই। দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ ও আত্মত্যাগ তাঁকে নিয়ে গেছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অনন্য উচ্চতায়। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ মানবিক রবিউল ভাইয়ের এসব উদ্যোগ আমাদের রবিউল হয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করছে প্রতিনিয়তই।

রবিউল ভাই চলে যাওয়ার পর থেকে পরিবারের সদস্যদের একটু বেশিই সচেতন থাকতে হয় সব সময়। ভাইয়ের কর্ম দেশের প্রত্যেকের কাছে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে নতুনভাবে। তিনি আমার থেকে আমাদের ভাই হয়ে উঠেছেন। আমি পেয়েছি বৃহৎ পরিবার। এতে দেশের প্রত্যেকের কাছে আমার, আমার পরিবারের দায়বদ্ধতাও জোরালো হয়েছে।

মানিকগঞ্জ পুলিশ লাইনেসর মূল ফটকের নামকরণ করা হয়েছে রবিউল করিমের নামে

রবিউল ভাইয়ের দুই সন্তান। বাবাকে হারানোর সময় সামির বয়স ছিল পাঁচ বছর। রায়নার জন্ম ঠিক এক মাস পর। সামির বাবার আদর কিছুটা পাওয়ার সুযোগ হলেও রায়না বাবাকে দেখার সুযোগও পায়নি। প্রতিনিয়ত তারা দুজনই নানাজনের কাছ থেকে বাবার গল্প শুনে বেড়ে উঠছে। এখন সামির বয়স ১২ বছর আর রায়নার ৭ বছর। বাবার পেশা ভীষণ সম্মানের ওদের কাছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে নেতিবাচক কোনো মন্তব্যে চুপচাপ দুজনই। ঈদসহ নানা উৎসবে বাবার পোশাক পরা ছবি সঙ্গে নিয়ে নিজেদের মধ্যে খুনসুটিতে মেতে থাকে সারাক্ষণ। বাবার সম্পর্কে জানতে চাইলে বিভিন্ন সময়ে শোনা গল্পগুলোই বলতে থাকে রায়না। বাবার বিষয়ে সামি সব সময়ই চুপচাপ। চাপা কষ্ট তাকে আঁকড়ে ধরে থাকে বোঝা যায় সহজেই। বাবার আদর্শে বড় হতে চায় সামি-রায়না।

মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বাসাই গ্রামে ব্লুমস বিশেষায়িত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন রবিউল করিম

দেশপ্রেমী রবিউল ভাইকে যথাযথ সম্মান দিতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি তাঁর সহকর্মীরা। রাজধানীর গুলশান থানার নতুন ভবনের সামনে রবিউল এবং একই ঘটনায় তৎকালীন বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন খান স্মরণে নির্মিত দীপ্ত শপথ ভাস্কর্য; রবিউল ভাইয়ের নামে মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের মূল ফটকের নামকরণ; মানিকগঞ্জের পুলিশ লাইনসের মূল ফটকের নামকরণ ও ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে। আত্মোৎসর্গকারী রবিউল ভাইকে মানুষের কাছে অনাদিকাল বাঁচিয়ে রাখতেই এ আয়োজন, যা সম্মানের ও বীরত্বের উপহার। এখান থেকে আমরা উৎসাহ পাই ভালো কাজ করার, কথা বলার।

* শামসুজ্জামান: রবিউল করিমের ছোট ভাই