গার্ড অব অনার নিচ্ছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তাঁর পেছনে বাঁয়ে তাজউদ্দীন আহমদ এবং ডানে এম এ জি ওসমানী। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে।
গার্ড অব অনার নিচ্ছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তাঁর পেছনে বাঁয়ে তাজউদ্দীন আহমদ এবং ডানে এম এ জি ওসমানী। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে।

২৬ মার্চ থেকেই বাংলাদেশ সরকার

আকবর আলি খান ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। অর্থসচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। অধ্যাপনা করেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর মারা গেছেন। ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে আকবর আলি খানের অগ্রন্থিত লেখা ও সাক্ষাৎকার: মুজিবনগর সরকার ও বর্তমান বাংলাদেশ বই থেকে ‘২৬ মার্চ থেকেই বাংলাদেশ সরকার’ শিরোনামের অধ্যায়টি পাঠকের জন্য প্রকাশ করা হলো।

মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকেই প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ সরকারের কাজ তৃণমূল পর্যায়ে শুরু হয়ে যায়। কারণ, ৭ মার্চ যখন বঙ্গবন্ধু ডাক দিলেন যে তাঁর নির্দেশে প্রশাসন পরিচালিত হতে হবে, তখন থেকেই কিন্তু প্রশাসন পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে পরিচালিত হতো না। মোটামুটিভাবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যেসব নির্দেশ দেওয়া হতো, সেগুলোই প্রতিপালন করা হতো।

২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর একটি বিপুল প্রভাব জনগোষ্ঠীর ওপর পড়ে। আমি হবিগঞ্জে তখন মহকুমা প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত ছিলাম। হবিগঞ্জে যখন সেই দায়িত্ব পালন করছিলাম, তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য হবিগঞ্জ মহকুমার মধ্যে ছিল না। তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছিল। কিন্তু তারা মুক্তিবাহিনীর কাছে পরাজিত হয় এবং তাদের যে কমান্ডার ছিলেন, একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় আগরতলায়। অন্যদিকে শমশেরনগরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ছিল। কিন্তু ইপিআরের বাঙালি সদস্যরা, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা সেখানে পাকিস্তানিদের নিরস্ত্র করেন। তাদের বাধ্য করেন পশ্চাদপসরণে। শুধু সিলেট বিমানবন্দরে কিছু পাকিস্তানি সেনা ছিল, আর কিছু সেনা ছিল কুমিল্লা সেনানিবাসে। বাকি অঞ্চল মোটামুটিভাবে মুক্ত ছিল। কাজেই জনগণের প্রত্যাশা ছিল মুক্তাঞ্চলে প্রশাসন চলবে। সে জন্য সরকারি অফিস-আদালত চালু রাখতে হয়েছে এবং সরকারি কর্মচারীরা যেন বেতন পান, ব্যাংকে যেন স্বাভাবিক লেনদেন হয়, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ না হয়, সে জন্য সামগ্রিকভাবে কিন্তু ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন চালু ছিল। ওই সময় আমাদের অনেক আদেশ দিতে হয়েছে, যা স্বাভাবিক পাকিস্তানি আইনে সম্ভব ছিল না। আমার মনে আছে, মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের আগে আমি হবিগঞ্জে অনেক আদেশ দিয়েছি, যেগুলোতে আমি লিখতাম, ‘বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে’। কিন্তু বস্তুত তখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়নি।

২.

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তখন আমাদের পুলিশ ব্যবস্থা চালু রাখতে হয়েছে, অফিস-আদালত খোলা রাখতে হয়েছে, ট্রেজারির কাজ চালাতে হয়েছে। একটা সময় দেখা গেল, মুক্তিবাহিনীর জন্য অস্ত্র লাগবে, সুতরাং সরকারের ট্রেজারিতে যেসব বন্দুক ও কার্তুজ ছিল, সেগুলো মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। তখন পুলিশ আমার কাছে এ ব্যাপারে লিখিত আদেশ প্রার্থনা করে। সে সময় আমি ট্রেজারি থেকে মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র ও কার্তুজ দেওয়ার জন্য পুলিশকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে লিখিত নির্দেশনা দিই।

এ সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনেক বাঙালি সেনা হবিগঞ্জে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং তেলিয়াপাড়ায় মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে প্রথম একটি ঘাঁটি গড়ে তোলেন। সে সময় সেই সেনাদের খাদ্য সরবরাহের একটি ব্যাপার সামনে চলে আসে। সে সময়ও আমি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে খাদ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিই কী পরিমাণ খাদ্যশস্য তাদের দিতে হবে।

৩.

এদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা সেনাদের সমন্বয়ে পাকিস্তানি বাহিনী নতুন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আমাদের মুক্তাঞ্চলের দিকে অভিযান পরিচালনা শুরু করল। সে সময় প্রথম পতন ঘটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার। আশুগঞ্জে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। তখন আমরা ভৈরবে। আমরা আশা করেছিলাম, মুক্তিবাহিনী ভৈরব সেতু উড়িয়ে দেবে। কিন্তু এই সেতু ওড়ানোর দায়িত্ব যাঁদের দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা ভৈরব সেতু না উড়িয়েই ফিরে আসেন।

সে সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মহকুমা প্রশাসক ছিলেন আমার বন্ধু ও সহকর্মী কাজী রকিবউদ্দীন সাহেব। পাকিস্তানিরা তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া অভিমুখে ঢাকা ও কুমিল্লা—এই দুই দিক দিয়ে অভিযান পরিচালনা করছিল। কাজী রকিবউদ্দীন সাহেব ১৫ কিংবা ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রশাসন পরিচালনা করতে পারেন। তারপর তিনি পশ্চাদপসরণ করে হবিগঞ্জে এসে আমার সঙ্গে যোগ দেন। ১৫ কিংবা ১৬ এপ্রিল থেকেই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, হয়তো পাকিস্তানি বাহিনী চলে এলে আমাদের পশ্চাদপসরণ করতে হবে। প্রস্তুতির প্রথম অংশ হিসেবে আমি আগরতলায় কর্নেল রবের সঙ্গে আলাপ করি। তখন কিন্তু মুজিবনগর সরকার সবে শপথ গ্রহণ করেছে। আমি তাদের নির্দেশ প্রার্থনা করি যে আমাদের যে ট্রেজারির টাকা আছে, সেটা দিয়ে কী করব? তখন মুজিবনগর থেকে জবাব এল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহায়তায় সেই টাকা আগরতলায় পাঠানোর ব্যাপারে। কিন্তু ব্যাংকের ম্যানেজার সরকারি নির্দেশ ছাড়া সেই টাকা আমাকে দিতে অস্বীকৃতি জানান। তখন আমি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সেই টাকা দেওয়ার আদেশ দিই এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে অনুরোধ করি, তারা যেন এই টাকা পাহারা দিয়ে আগরতলায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে।

আমি নিজে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদের সঙ্গে নিয়ে প্রায় তিন কোটি টাকা আগরতলায় নিয়ে যাই। সেই টাকা পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যয় করা হয়। আমাদের অন্য সহকর্মীরাও বিভিন্ন জায়গা থেকে এভাবে মুজিবনগরে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেও তিন-চার কোটি টাকা মুজিবনগরে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু পথিমধ্যে এর কিছু টাকা লুট হয়ে যায়। সম্পূর্ণ নয়, আমার যতটুকু মনে আছে, প্রায় দেড় কোটি টাকা সে সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পাঠানো গিয়েছিল। বাকি টাকা লুট হয়ে যায়। মূলত কিছু সুযোগসন্ধানী এ টাকা লুট করে।

অগ্রন্থিত লেখা ও সাক্ষাৎকার: মুজিবনগর সরকার ও বর্তমান বাংলাদেশ আকবর আলি খান

৪.

আগেই বলেছি, পাকিস্তান সেনাবাহিনী দুই দিক দিয়ে সিলেটের দিকে আসছিল। একটি দল কুমিল্লা থেকে বেরিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে সিলেটের দিকে আসছিল, আরেকটি দল সিলেট বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিকে আসছিল। সে সময় হবিগঞ্জ আমাদের জন্য বেশ অনিরাপদ হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা তখন আমাকে পরামর্শ দেন যে দিনের বেলা হবিগঞ্জে দাপ্তরিক কাজকর্ম সেরে রাতের বেলা চা-বাগানের দিকে থাকতে।

একদিন রাত ১২টার দিকে আওয়ামী লীগের নেতা ও বর্তমানের (২০১১) সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ আমার কাছে এলেন। তিনি আমাকে আগে থেকেই চিনতেন। তিনি এসে বললেন, হাতে একদম সময় নেই, যেকোনো সময় পাকিস্তানি বাহিনী হবিগঞ্জে চলে আসবে। তিনিই আমাদের নিয়ে আগরতলার উদ্দেশে রওনা দেন। আমরা সেই রাতটি কাটিয়েছিলাম আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা বরাবর একটি চা-বাগানে। সেখানে আমি, কাজী রকিবউদ্দীন ও এনামুল হক মোস্তফা শহীদ চা-বাগানের কুলিদের একটি কুঁড়েঘরে আশ্রয় নিই। সেই রাতটি ওখানে কাটিয়ে পরদিন একপর্যায়ে আমরা আগরতলায় পৌঁছাই।

আগরতলায় গিয়ে দেখি, সেখানে আমার অনেক সহকর্মীই এসেছেন। দেখি, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হোসেন তৌফিক ইমামও এসেছেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়ে প্রথমে সাবরুম নামের একটি ছোট জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি আগরতলায় এসে উপস্থিত হন।

আগরতলায় বাংলাদেশ সরকারের একটি আঞ্চলিক কার্যালয় করা হয়। সেখানে ছিলেন এম আর সিদ্দিকী, সামরিক নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল রব। পরবর্তী সময়ে এখানে জহুর আহমদ চৌধুরী এসে যোগ দেন। অন্যান্য অঞ্চলেও এমন আঞ্চলিক প্রশাসন গড়ে ওঠে।

৫.

আমি মে থেকে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আগরতলায় দায়িত্ব পালন করি। সে সময় অন্যান্য কাজের মধ্যে আমাদের একটি কাজ দেওয়া হয়েছিল। সেটা হলো সীমান্তের পার্শ্ববর্তী যেসব চা-বাগান ছিল, সেখানে অনেক চা মজুত ছিল। তখন মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হলো, এই চা ভারতে নিয়ে এসে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা কয়েকটি চা-বাগান থেকে সেই চা আনতে সক্ষম হই। সেই চা বিক্রি করতে করতে অবশ্য অনেক সময় লেগে যায়। যখন চা বিক্রি হয়, তখন আমি আগরতলায় ছিলাম না। কলকাতায় চলে আসি। পরে শুনেছিলাম, সেই চা বিক্রি করে এর মূল দামের এক-দশমাংশও নাকি আমরা পাইনি। খুব একটা লাভজনক ছিল না সেই চা বিক্রির ব্যাপারটি। তবে এর দুটি উদ্দেশ্য ছিল। একটি হলো পাকিস্তানিরা যেন সেই চা বিক্রি বা ব্যবহার করতে না পারে, সেই উদ্দেশ্য আমাদের পূরণ হয়েছিল। অন্যটি হলো প্রবাসী সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা। এতে আংশিকভাবে আমরা সফলতা অর্জন করি।

আগস্ট মাসের দিকে যখন প্রবাসী সরকার মোটামুটিভাবে গুছিয়ে উঠছে এবং তারা কলকাতায় নতুন নতুন মন্ত্রণালয় স্থাপন করা শুরু করেছে, তখন আমাকে বলা হলো কলকাতায় গিয়ে মুজিবনগর সরকারের কাজে যোগদানের জন্য। আমি আগস্ট মাসে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যোগ দিই। সে সময় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব হয়েছিলেন তৌফিক ইমাম সাহেব। আমি মাসখানেক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।

সম্ভবত সেপ্টেম্বর মাসের দিকে সিলেটের সাবেক ডিসি আবদুস সামাদ মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যোগ দেন। তাঁকে পেয়ে সরকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গঠন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। সামাদ সাহেব যোগ দেওয়ার পর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত হলে আমাকে সেই মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমি সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত এই পদে দায়িত্ব পালন করি।

বঙ্গবন্ধু যখন ফিরে আসেন, তখনো কিন্তু কারা দালাল আর কারা দালাল নন, সে বিষয়ে টানাপোড়েন চলছিল। বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার পর কিন্তু বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাকে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রমাণিত হওয়ায় চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এঁদের মধ্যে আবার দু-একজন তদবির করে চাকরিতে পুনর্বহালও হয়ে যান। তবে এঁদের বেশির ভাগই ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পুনর্বাসিত হননি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে পাকিস্তানি বাহিনীর তাঁবেদার হিসেবে যাঁরা চিহ্নিত হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই পুনর্বাসিত হয়ে যান।

সামরিক বাহিনীতে সে সময় মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারীদের দুই বছরের সিনিয়রিটি দেওয়া হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সময় বেসামরিক প্রশাসনে কাউকে দুই বছরের জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়নি। এটি করা হয় জিয়াউর রহমানের আমলে। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।

১৬.১২.২০১১