হ্যাচারিতে চিংড়ির পোনা উৎপাদন তদারকি করছেন মৎস্যচাষি ইয়াছিন(ডানে)। গত শনিবার চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার জুলধা ইউনিয়নের মদিনা গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে
হ্যাচারিতে চিংড়ির পোনা উৎপাদন তদারকি করছেন মৎস্যচাষি ইয়াছিন(ডানে)। গত শনিবার চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার জুলধা ইউনিয়নের মদিনা গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে

হ্যাচারির পাশাপাশি পুকুরেও গলদার পোনা চাষ করে সাফল্য

শুরুটা ১৯৯২ সালে। সে সময় নদীতে মাছ ধরে তা বিক্রি করতেন মোহাম্মদ ইয়াছিন (৪৯)। সে সুবাদে পরিচয় হয় এক মাছ ব্যাপারীর সঙ্গে। এরপর তাঁর সঙ্গেই সাতক্ষীরা গিয়ে চিংড়ি ব্যবসার সঙ্গে পরিচিত হন। এরপর অন্যদের কাছ থেকে চিংড়ি সংগ্রহ করে তা বিক্রি করতেন তিনি। গত বছর প্রথমবারের মতো পুকুরে ও হ্যাচারিতে গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদনে উদ্যোগ নেন ইয়াছিন।

প্রথম বছরে পুরোপুরি সাফল্যের মুখ না দেখলেও এ বছর সাফল্য পেয়েছেন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার জুলধা ইউনিয়নের এই চিংড়িচাষি। নিজের চারটি পুকুর ও হ্যাচারির ১৩টি কনটেইনারে এবার গলদার চিংড়ির পোনা উৎপাদন করেছেন তিনি। আশা করছেন, এ বছর প্রথম ধাপে প্রায় ৫৫ লাখ গলদা চিংড়ির পোনা বিক্রি করতে পারবেন তিনি। ইতিমধ্যে দুই লাখের কাছাকাছি লার্ভা বিক্রিও করেছেন ইয়াছিন। দাম পড়েছে প্রতিটি ২ টাকা ৫০ পয়সা।

জেলা মৎস্য দপ্তর জানিয়েছে, দেশে গলদা চিংড়ি চাষে মাত্র ৫ শতাংশ পোনা সরবরাহ করতে পারে দেশের হ্যাচারিগুলো। ৯৫ শতাংশ পোনা চোরাই পথে ভারত থেকে আসে অথবা অবৈধভাবে নদী থেকে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। চোরাই পথে আসা পোনা চড়া দামে সংগ্রহ করতে হয়।

কর্ণফুলী উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা স্বপন দে বলেন, সংকট মেটাতে পুকুরে গলদা পোনা উৎপাদনের চেষ্টা চলছিল অনেক দিন ধরে। সে জায়গা থেকে সফল হয়েছেন ইয়াছিন। বর্তমানে চট্টগ্রামে ইয়াছিনই একমাত্র চিংড়ি চাষি যিনি গলদার পোনা উৎপাদন করছেন। তাই তাঁকে সব ধরনের পরামর্শ ও সহায়তা মৎস্য অফিস থেকে দেওয়া হচ্ছে।

প্রতিকূলতায় পোনা চাষ

অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে ধরা পড়া গলদা চিংড়ির পোস্ট লার্ভা। গত শনিবার মদিনা গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে

জানা গেছে, গলদা চিংড়ির জীবনচক্রে চারটি প্রধান অবস্থা রয়েছে। ডিম, লার্ভা, পোস্টলার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ চিংড়ি। ২৮ থেকে ৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ডিম ফুটতে প্রায় ১৮ থেকে ২১ দিন সময় লাগে। এরপর মোট ১১টি ধাপ পেরিয়ে পোস্টলার্ভা পর্যায়ে যেতে হয়। তবে অধিকাংশ চাষিদের ক্ষেত্রে পোস্টলার্ভা অবস্থা পর্যন্ত যেতেই লার্ভা মারা যায়।

গত শনিবার ইয়াছিনের মদিনা গলদা চিংড়ি হ্যাচারি ও পুকুরগুলো ঘুরে বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখা যায়। ইয়াছিনের চারটি পুকুরে গলদা উৎপাদনের প্রক্রিয়া চলছে। পুকুরে প্রাকৃতিক পরিবেশে লার্ভাগুলো বড় হচ্ছে। পুকুরে কিছু লার্ভা বর্তমানে পোস্টলার্ভা বা পিএল পর্যায়ে এসেছে।

অন্যদিকে হ্যাচারিতে ১৩টি কনটেইনারের সব কটিতে পোস্টলার্ভা দেখা গেছে। প্রথম পর্যায়ে পুকুর ও হ্যাচারিতে ২৫০টি মা গলদা ছেড়েছেন ইয়াছিন। খালি চোখে পোস্টলার্ভাগুলো পুরোপুরি বোঝার উপায় নেই। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রেখে গলদার পোস্টলার্ভাগুলো দেখালেন হ্যাচারির কর্মীরা। তাতে দেখা যায়, ক্ষুদ্র গলদার চিংড়ির আকার নিয়েছে পোস্টলার্ভাগুলো।

মোহাম্মদ ইয়াছিন প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর অধিকাংশ চিংড়ি লার্ভা অবস্থাতেই মারা গেছে। তবে এ বছর সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করেছেন তিনি। ফলে এ বছর প্রথম ধাপে অধিকাংশ লার্ভাই পোস্টলার্ভা অবস্থায় পৌঁছেছে। এখন পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকার বেশি।

লাভবান হবেন চাষিরা

আন্তর্জাতিক বাজারে গলদা চিংড়ির চাহিদা রয়েছে। বড় আকারের গলদা চিংড়ির দাম প্রতি কেজি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৪০০ পর্যন্ত হয়ে থাকে। চোরাই পথে পোস্টলার্ভা আসার কারণে চাষিদের আয়ের অংশ দেশের বাইরে চলে যায়। দেশে পোস্টলার্ভা উৎপাদন বাড়লে তা চাষিদের জন্য লাভবান হবে বলে মনে করে গবেষক ও মৎস্য কর্মকর্তারা।

চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গলদা চিংড়ির চাহিদা ব্যাপক। ইয়াছিনের মতো বাকিরাও এই উদ্যোগ নিলে দেশের গলদা উৎপাদনের চাহিদার পর্যাপ্ত পোস্টলার্ভা দেশেই উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

হ্যাচারির পাশাপাশি পুকুরে গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদন হয়। পুকুর থেকে পোনা সংগ্রহে ব্যস্ত দুই শ্রমিক। গত শনিবার মদিনা গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে

দেশে বর্তমানে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বরগুনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী ও ময়মনসিংহে চিংড়ি চাষ হয়। রপ্তানির জন্য ১০৫টি চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানা রয়েছে। তবে শুধু গুটিকয় চাষি পুকুরে গলদার পোস্টলার্ভা উৎপাদনে সফল হয়েছেন।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের আওতাধীন চিংড়ি গবেষণাকেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. হারুনর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশে এ বছর গলদা চিংড়ির উৎপাদনে ধস চলছে। এর মূল কারণ তাপমাত্রা। তাঁর মধ্যে ইয়াছিনের এ সাফল্য অবশ্যই সুখবর। দেশে যদি এ ধরনের উদ্যোগ বাড়ে তাহলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য লাভজনক।