অর্থনীতির সাফল্যের পেছনে সামাজিক সূচকের অগ্রগতির প্রভাব অনেক। তবে কোভিড কতটা পিছিয়ে দিল, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
স্বাধীনতার পরপর দেশের একজন সাধারণ বা গড়পড়তা নাগরিকের জীবনযাপন কেমন ছিল, তার একটি বর্ণনা আছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে। ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বিশ্বব্যাংক লিখেছিল, ‘এখানকার ৯০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে এবং ৮০ শতাংশই কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত। গ্রামবাসীর মালিকানায় থাকা গড় জমির পরিমাণ দেড় একর।
এর বাইরে তারা সচ্ছলদের কাছ থেকে আরও ১ একর জমি ধার নিয়ে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এই জমি আবার ১০ বা এরও বেশি ভাগে বিভক্ত। অনেক জমির অবস্থান নিজের ঘরের চেয়ে বহুদূরে। জমি চাষের জন্য তাদের একটা করে অস্থিসার গরু আছে। প্রায় প্রত্যেক পরিবারই দুই বেলা খাওয়ার জন্য চাল ঘরে রাখে। কোনো উৎসব, বিয়ে বা অন্য কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য তারা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে অর্থ ধার করে।
বেশি প্রয়োজনে অবশ্য তারা মহাজনদের কাছে যায়। যেহেতু প্রায় সবাই দিন আনে দিন খায়, সে কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কেবল সুদ পরিশোধ করতে পারে, আসল আর পরিশোধ করতে পারে না। কোনো এক বছরে ফসলের বড় ক্ষতি হলে তারা গভীর দেনায় ডুবে যায়। আর যাদের কোনো জমিই নেই, তাদের অবস্থা আরও খারাপ। এক–পঞ্চমাংশেরই আসলে কোনো জমি নেই। তাদের বাড়িঘর অনেক ছোট ও জীর্ণ। সাধারণত ধানের খড় দিয়ে বাড়ির চালা বানানো হয়, যা বর্ষার সময় মোটেই টিকে থাকে না। তারা মূলত জমির মালিকের দয়ার ওপর টিকে থাকে এবং খারাপ ফসলের মৌসুমে বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়।’
মূলত এ রকম এক অবস্থা দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পথচলা শুরু হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক তখন ওই প্রতিবেদনেই বলেছিল, ‘সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল। এখানকার মানুষ অত্যন্ত দরিদ্র, মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলারের মধ্যে, যা গত ২০ বছরে বাড়েনি, জনসংখ্যার প্রবল আধিক্য, প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ৪০০ মানুষ বাস করে, তাদের জীবনের আয়ুষ্কাল অনেক কম, ৫০ বছরের নিচে, বেকারত্বের হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে এবং জনসংখ্যার বড় অংশই অশিক্ষিত।’
বিশ্বব্যাংক তখন কিছুটা রেখেঢেকে বললেও বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ অবশ্য খোলামেলাভাবেই বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। যেমন নরওয়ের ইয়ুস্ট ফালান্দ ১৯৭৬ সালেই সরাসরি লিখেছিলেন যে বাংলাদেশ আসলে অর্থনীতিতে টিকে থাকতে পারবে না। আজীবনই বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করে থাকতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনের একসময়ের প্রেসিডেন্ট, প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অস্টিন রবিনসন স্পষ্টতই লিখেছিলেন, এখানে উৎপাদনের তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি। এর ফল হচ্ছে—দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ ও মৃত্যু। তিনি হিসাব দিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশকে মাথাপিছু আয় ৯০০ ডলারে নিতেই প্রয়োজন হবে ৯০ থেকে ১২০ বছর।
৫১ বছর পর সেই বাংলাদেশেরই মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ ডলার (দুই লাখ ৯৬ হাজার ৫২০ টাকা)। আসলে শুরু থেকেই অর্থনীতিবিদেরা বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে প্রধান সমস্যা ধরে নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে। তারা বলেছিল, জনসংখ্যার বড় অংশ অশিক্ষিত, কৃষির ওপর তারা নির্ভরশীল, তাদের আয়ু কম, কোনো শিল্পপণ্য নেই, অর্থনীতিতে মেয়েদের অংশগ্রহণ খুবই সামান্য।
আর এখন গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের অগ্রগতির পেছনে অর্থনীতিতে নারীর উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণের ভূমিকা অনেক। মাথাপিছু আয় যেমন বেড়েছে, তেমনি কমেছে শিশুমৃত্যু ও সন্তান প্রসবকালে মাতৃমৃত্যুর হার। নারীর কর্মসংস্থান বেড়েছে, মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের মতো সূচকেও বাংলাদেশের অগ্রগতি ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও অনেক বেশি।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে যে সামাজিক সূচকের এসব অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য প্রভাব রেখেছে, তা বাংলাদেশের উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ‘অ্যাসপিরেশনাল মোমেন্টাম: দ্য ডেভেলপমেন্ট স্টোরি অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখিয়েছে। এ নিয়ে গবেষকেরা বলেছেন, দেশের নিম্নবিত্ত ও গরিব মানুষ স্বল্পমূল্যের খাওয়ার স্যালাইন পদ্ধতি, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ও কৃষি উপকরণ সাদরে গ্রহণ করেছে। বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষদের সচেতন করেছে, উপকরণ সরবরাহও করেছে। সরকারও দিয়েছে নীতিসহায়তা। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে এর বড় ভূমিকা রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ কেমন করছে, তার একটি চিত্র পাওয়া যায় বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে। তবে এর বেশ কিছু পরিসংখ্যান সমসাময়িক, কিছু করোনার আগের সময়ের। যেমন দারিদ্র্যসীমার নিচে (দিনে আয় ২ দশমিক ১৫ ডলার) বাস করে এমন মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে এখনো অনেক বেশি।
পাকিস্তানে এর হার মাত্র ৪ দশমিক ৯ শতাংশ, ভারতে ১০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ১ দশমিক ৩ শতাংশ এবং বাংলাদেশে সাড়ে ১৩ শতাংশ। গবেষকেরা মনে করেন, করোনার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তবে এ নিয়ে বাংলাদেশ গত পাঁচ বছরে আর কোনো সমীক্ষা করেনি।
প্রত্যাশিত গড় আয়ুর দিক থেকে অবশ্য বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। এখানে এখন তা ৭২ দশমিক ৮ বছর। আর ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানে গড় আয়ু ৬৬ বছর, ভারতে ৭০ বছর এবং শ্রীলঙ্কায় ৭৬ বছর। আবার ওই বছরের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৮ শতাংশ, ভারতে দশমিক ৮ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ১ দশমিক ১ শতাংশ। আর কিছুদিন আগে প্রকাশিত জনশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে এই হার ১ দশমিক ২২ শতাংশ।
২০২১ সালে করা বিআইডিএসের আরেক গবেষণায় প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক বিনায়ক সেন দেখিয়েছেন, সব মিলিয়ে ১৪টি সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় এগিয়ে। এর মধ্যে পাকিস্তানের তুলনায় এগিয়ে আছে শিশুমৃত্যুর হার, পাঁচ বছরের কম শিশুমৃত্যুহার, জন্মহার, গড় আয়ু, বয়স্ক শিক্ষার হার এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের সূচকে। মূলত কর্মবাজারে মেয়েদের অংশগ্রহণ, মাতৃমৃত্যুর হার, পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুহার, নারীদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার হারের দিক থেকে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ প্রায় সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও সামাজিক সূচকে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া নিয়ে একাধিকবার লিখেছেন।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে থাকা অতিমারি কোভিড-১৯ এবং এর পরের অর্থনৈতিক সংকটে অনেক সামাজিক সূচকেরই অর্জনই এখন ঝুঁকিতে। নানা সামাজিক সূচকের ওপর অতিমারির প্রভাব নিয়ে তেমন কোনো সমীক্ষাও করা হয়নি। এমনকি দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিয়েও নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই সরকারের কাছে। তবে অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, কোভিড ও অর্থনীতির সংকট অনেক সামাজিক সূচককেই দুর্বল করে দিয়েছে। ফলে অনেক অর্জনই আসলে ঝুঁকির মধ্যেই। এ বিষয়ে সরকার নজর না দিলে অর্থনীতিও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে পড়বে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক বাংলাদেশ গভর্নিং বডির চেয়ারপারসন হোসেন জিল্লুর রহমান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, করোনার ধাক্কায় সামাজিক খাতে সরাসরি প্রভাব পড়তে শুরু করে। মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলোয় খরচ কমিয়ে ফেলে। এসবের সঙ্গে মানুষের আয়ের বিষয়টি জড়িত ছিল। কিন্তু অন্য আরও বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি হলো। যেমন এর ফলে শিখনঘাটতি দেখা দিল, বাল্যবিবাহের সংখ্যাও বাড়তে শুরু করল ব্যাপকভাবে।
মাতৃ বা শিশুস্বাস্থ্যের বিষয়গুলো ধাক্কা খেল। তৃতীয় আরেকটি প্রভাব পড়েছে, যা নিয়ে আলোচনা তেমন হচ্ছে না। সেটি হলো, করোনার ধাক্কা সামলাতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে একমাত্রিকভাবে প্রাধান্য দেওয়া। এটার ভালো দিক অবশ্যই আছে। কিন্তু সামাজিক পুনরুদ্ধারের বিষয়টি আলোচনার মধ্যেই এল না।
এর ফলে শিখনঘাটতির সমস্যার পাশাপাশি সচেতনতার ক্ষেত্রেও ক্ষতি হয়েছে। বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার পেছনে এর একটা সম্পর্ক আছে। এর একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আছে। শিখনঘাটতি, বাল্যবিবাহ, নারীর স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলোর পুনরুদ্ধারে দীর্ঘ সময় লাগবে বলে ধরে নেওয়া যায়।
সবশেষে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, করোনার পর এখন আবার অর্থনৈতিক সংকট শুরু হওয়ায় সামাজিক খাতের ব্যয়ে কাটছাঁট শুরু হয়েছে। আর ইতিমধ্যে সৃষ্টি হওয়া সচেতনতার ঘাটতিতে সামাজিক কৌশলগত বিনিয়োগের সুযোগগুলো আরও সংকুচিত হয়ে উঠেছে। এর ফলে সামাজিক সূচকের অগ্রগতির শ্লথ হয়ে যাওয়ার এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে উল্টো দিকে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সার্বিক উন্নয়নে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে মনে হয়।