সিগারেটের ওপর যে হারে কর আরোপ হয়, তাতে একে নিরুৎসাহিত করার পরিকল্পনা থাকছে না।
প্রতিবছর বাজেটে সিগারেটের ওপর কর বাড়ছে। তাতে অবশ্য আশানুরূপভাবে কমছে না ধূমপান। সিগারেট বিক্রিও বাড়ছে। বাড়ছে তামাকের চাষও।
তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা বলছেন, সিগারেটের ওপর যে হারে কর আরোপ হয়, তাতে একে নিরুৎসাহিত করার পরিকল্পনা থাকছে না। জনস্বাস্থ্যকে মাথায় রেখে পরিকল্পিতভাবে কর বাড়ালে তামাক ব্যবহার কমবে, আবার রাজস্বও বাড়বে।
ধূমপানবিরোধী ব্যক্তিরা বলছেন, যে ধরনের কঠোরতা আরোপ করা উচিত, তা বাস্তবে করা হয় না। তাই ধূমপান দিন দিন বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে তামাক ব্যবহারজনিত রোগও। এ অবস্থায় আজ বুধবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘তামাক নয়, খাদ্য ফলান’।
জনস্বাস্থ্য রক্ষায় মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করা দরকার। একটি জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ করনীতি প্রণয়ন করা জরুরি।সৈয়দ মাহবুবুল আলম, কারিগরি উপদেষ্টা, তামাকবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন দ্য ইউনিয়ন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০২২ সালের ‘টোব্যাকো: থ্রেট টু আওয়ার এনভায়রনমেন্ট’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের দেড় কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সিগারেট খান। বিড়ি খান ৫৩ লাখ মানুষ। আর ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করেন।
তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে বিদায়ী অর্থবছরে (২০২২–২৩) বাজেটে এতে অতিরিক্ত কর আরোপ করা হয়। প্রতিবছরই বাজেটে তামাকের ব্যবহার কমানোর কথা বলা হয়ে থাকে। আর এ জন্য কর আরোপও আগের বছরের চেয়ে বাড়ে। সেই সঙ্গে বাড়ে তামাক থেকে সরকারের রাজস্ব আয়। ২০১০-১১ অর্থবছরে তামাক ও তামাকজাত পণ্য থেকে সরকারের রাজস্ব আয় ছিল ৭ হাজার ৬৯১ কোটি টাকার বেশি। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে এ আয় বেড়ে হয় ২৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকার বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ আয় ৩০ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা ছাড়ায়।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসির প্রতিনিধি হামিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাজেটে তামাকের ব্যবহার কমানোর কথা বলে কর আরোপ করা হলেও বাস্তবে রাজস্ব আয়ের বিষয়টিই মূল লক্ষ্য থাকে। জনস্বাস্থ্য এখানে বিচার্য বিষয় হিসেবে থাকে না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে দেখা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে প্রিমিয়াম, উচ্চ, মাঝারি ও নিম্নস্তরের ৭ হাজার ১৫৯ কোটির বেশি সিগারেট শলাকা বিক্রি হয়েছে। পরের বছর তা বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ৫৬৪ কোটির বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ৫ হাজার ১৯৫ কোটি সিগারেট শলাকা বিক্রি হয়েছে। যদি মাসভিত্তিক হিসাব বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাতে দেখা যায়, এ বছরও সিগারেটের বিক্রি আগের বছরকে ছাড়িয়ে যাবে।
তামাকের ওপর কর যে হারে বাড়ানো হয়, তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের। তাঁর মতে, প্রকৃতপক্ষে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় আরও সস্তা হয়ে পড়ছে তামাক পণ্য।
সিগারেট বাজারের ৭৫ শতাংশ দখলে থাকা নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম চলতি বাজেটে (২০২২–২৩) বাড়ানো হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। বহুল ব্যবহৃত জর্দা, গুল ও বিড়ির দাম অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। তামাক পণ্যের প্রকৃত মূল্য হ্রাস পাওয়ায় তরুণ ও নিম্ন আয়ের মানুষ এসব পণ্য ব্যবহারে উৎসাহিত হবে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।
বাংলাদেশ বিশ্বের নবম বৃহত্তম তামাক ব্যবহারকারী দেশ। দেশের ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার করে। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি ২০১৯–এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের প্রধান চারটি কারণের একটি তামাক। তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।
তামাকের জন্য এসব ক্ষতি হলেও দেশের তামাক চাষের এলাকা এবং এর উৎপাদন বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ সালে দেশের ৯৯ হাজার ৬০০ একরের বেশি জমিতে তামাকের চাষ হয়। এ সময় ৮৯ হাজার ২ মেট্রিক টন তামাক উৎপাদিত হয়। পরের অর্থবছরে তামাক চাষের জমির এলাকা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৮৪ একরের বেশি জমি। আর তামাক উৎপাদিত হয় ৯২ হাজার ৩২৬ মেট্রিক টন।
তামাকবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন দ্য ইউনিয়নের কারিগরি উপদেষ্টা সৈয়দ মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করা দরকার। একটি জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ করনীতি প্রণয়ন করা জরুরি।