সূর্যাস্তের ঠিক আগ মুহূর্তে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের আকিলপুর সৈকত
সূর্যাস্তের ঠিক আগ মুহূর্তে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের আকিলপুর সৈকত

পাহাড় যেখানে এসে হেলে পড়েছে সাগরে

মেঘ-পাহাড়ের মিতালি। পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঝরনা। পাহাড়গুলো যেন এক জায়গায় এসে হেলে পড়েছে সাগরে। সেই জায়গাটি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড। এখানে ভ্রমণপিপাসু লোকজনের জন্য রয়েছে বিস্ময়ের অফুরন্ত ভান্ডার। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝরনা, নিবিড় বনে ঢাকা উঁচু পাহাড় সারি আর নিরিবিলি সাগর সৈকত। আঁকাবাঁকা ভাঁজ করা সবুজ গালিচার সৈকতের দেখা মিলবে কেবল সীতাকুণ্ড এলেই।

এই শীতকাল হতে পারে সীতাকুণ্ডে বেড়ানো আর ট্র্যাকিং করার উপযুক্ত সময়। হালকা ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে এখন পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠা সহজ। বুনো প্রান্তর আর সৈকতের দৃশ্যও এই আবহাওয়ায় মনোরম লাগবে। চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ৪৫ মিনিট দূরত্বের সীতাকুণ্ডে এক দিন সময় নিয়েই বেড়িয়ে আসা সম্ভব।

সীতাকুণ্ডে রয়েছে ছয়টি ঝরনা, পাহাড়ের চূড়ায় চন্দ্রনাথ মন্দির, অগ্নিকুণ্ড মন্দির, দুটি আলাদা বৈশিষ্ট্যের সৈকত গুলিয়াখালী ও আকিলপুর, সাগর বুকে ৭০০ মিটারের কুমিরা জেটি, লবণাক্ষ ও ভাটিয়ারী নামের দুটি হ্রদ এবং বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক। রয়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে নির্মিত দ্বিতীয় প্রাচীন মসজিদ, যার নাম গায়েবি মসজিদ।

যেভাবে শুরু করতে পারেন ভ্রমণ

শুরুতেই ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম থেকে যেকোনো বাসযোগে সীতাকুণ্ড পৌর সদরের বাসস্ট্যান্ডে নামতে হবে। ভালো হয় বাস থেকে নেমে বিশ্রামের জন্য যেকোনো একটি হোটেল কিংবা হোমস্টে কক্ষ ভাড়া করা। সীতাকুণ্ডে বিভিন্ন মানের ১৯ হোটেল রয়েছে। এ ছাড়া অন্তত ১০টি হোমস্টে রয়েছে। ৩০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যেই কক্ষ ভাড়া পাওয়া যায়। এরপর ফ্রেশ হয়ে নাশতা সেরে হালকা ওজনের ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন। খেয়াল রাখতে হবে ভ্রমণ শুরু আগেই বিশ্রাম করতে গিয়ে যেন বেলা পড়ে না যায়।

শুরুতেই আপনি বাছাই করতে পারেন পাহাড়ের একটি স্পট। চাইলে ঝরনা আছে, এমন পাহাড়ও বাছাই করা যায়। কিংবা মেঘ-পাহাড়ের মিতালির সেই চন্দ্রনাথ পাহাড় ভ্রমণ তালিকায় রাখতে পারেন। যে পাহাড়ই হোক, শীতের সকালে পাহাড় বেয়ে উঠলে আপনার তেমন ক্লান্তি অনুভব হবে না। পাহাড় থেকে দুপুরের খাবারের আগেই ফিরতে হবে। এরপর খাবার সেরে কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম নিয়ে যেকোনো একটি সৈকত কিংবা হ্রদ বেছে নিতে পারেন বেড়ানোর জন্য।

ভূমি থেকে ১২০০ ফুট উপরে থাকা চন্দ্রনাথ মন্দির থেকে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে বিরুপাক্ষ মন্দির যেমন দেখা যায়। সম্প্রতি তোলা

চন্দ্রনাথ পাহাড়

সীতাকুণ্ড পৌর সদরের মহন্তের হাট থেকে মন্দির সড়ক ধরে দুই কিলোমিটার গেলেই পাওয়া যাবে চন্দ্রনাথ পাহাড়। যেতে যেতে পথে পড়বে বিভিন্ন মঠ মন্দির। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যভরা পাহাড়টি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার ২০০ ফুট উঁচু। পাহাড়টির একেবারে চূড়ায় রয়েছে চন্দ্রনাথ মন্দির। দ্বিতীয় বৃহত্তম চূড়ায় বিরূপাক্ষ মন্দির। চূড়ায় ওঠার সময় পথে পথে বানরের দেখা মিলবে। শোনা যাবে পাখিদের কিচিরমিচির। বিরূপাক্ষ মন্দিরের কাছাকাছি গেলে মেঘের ছোঁয়া পাওয়া যেতে পারে। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পর ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীরে চারদিকে সবুজ পাহাড় দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে যাবে। তবে পাহাড় ভ্রমণে অবশ্যই প্রয়োজনীয় পানীয়জল নিয়ে যেতে হবে সঙ্গে।

ইকোপার্ক পাহাড় ও সহস্রধারা ঝরনা-১

সীতাকুণ্ড পৌর সদর থেকে সিএনজি অটোরিকশা ধরে তিন কিলোমিটার গেলেই ইকোপার্কের ফটক। এরপর টিকিট কেটে পার্কের ভেতরে প্রবেশ করলেই শুরু হবে মূল ভ্রমণ। পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত আপনি সিএনজি অটোরিকশাযোগে অথবা পায়ে হেঁটেও ঘুরে আসতে পারেন। তবে পায়ে হেঁটে বেড়ানোর আনন্দটাই আলাদা।

গাছগাছালিতে ভরা পাহাড়টিতে দেখা মিলবে বনমোরগ, হনুমানসহ নানা বন্য প্রাণীর। শোনা যাবে ঝিঁঝিপোকার ডাক। দেখা মিলবে সহস্রধারা-১ ঝরনার। ওই ঝরনার কাছে যেতে হলে খাড়া পাহাড় বেয়ে আবার নিচে নামতে হবে। কঠোর এক পরিশ্রমের পর ঝরনার কাছে পৌঁছানো গেলে পর্যটকদের আনন্দের সীমা থাকে না। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীরটি ঝরনার পানিতে ভিজিয়ে নিতে ভোলেন না কেউ।

চন্দ্রনাথ পাহাড়ে চূড়ায় ওঠার পথে বানরের দেখা মিলতে পারে। সম্প্রতি চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে তোলা

লবণাক্ষ হ্রদ ও সহস্রধারা ঝরনা-২

সীতাকুণ্ড পৌর সদর থেকে মিনিবাস কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা যোগে ছোট দারোগাহাট নামতে হবে। এরপর হেঁটে কিংবা সিএনজি অটোরিকশাযোগে সূর্য মন্দির যেতে হবে। তারপর টিকিট কেটে লবণাক্ষ হ্রদ বেড়াতে পারেন। নৌকাভ্রমণ করতে করতে একসময় পৌঁছে যাবেন সহস্রধারা ঝরনা-২ এ। সেখানে ঝরনার জলে গা ভাসিয়ে দিতে পারেন।

তিনটি সৈকত

সীতাকুণ্ড ভ্রমণে আসা পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকে গুলিয়াখালী সৈকত। বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এ সৈকতকে বেছে নিতে পারেন আপনিও। সবুজ চাদরে ঢাকা এ সৈকতের আঁকাবাঁকা ভাঁজে ভাঁজে জমে রয়েছে পানি। সৈকতজুড়ে রয়েছে ম্যানগ্রোভ বন। সৈকতে গেলেই খালি পায়ে হাঁটতে ইচ্ছা করবে আপনারও। এখন শুষ্ক মৌসুম। বিকেলের মিষ্টি রোদে সাগরের ঢেউ বিহীন শান্ত জলরাশি ডাকে পর্যটকদের। মনের অজান্তেই সাগরের নোনাজলে কখন যে নেমে পড়বেন, তা টেরই পাবেন না।

বিকেলের বেড়ানোর জন্য পছন্দের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রাখতে পারেন একসঙ্গে ভিন্ন প্রকৃতির দুটি সৈকত বাঁশবাড়িয়া ও আকিলপুর। সেখান থেকে যেতে পারেন কুমিরা জেটি। এই তিনটি স্পট তিন কিলোমিটার জায়গার মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় খুব সহজেই এক সঙ্গে ঘুরে দেখা যাবে।

সবুজ গালিচায় ঢাকা গুলিয়াখালী সৈকত

ভাটিয়ারী লেক ও সানসেট পয়েন্ট

সূর্যাস্ত দেখা এবং নৌকাভ্রমণের জন্য পছন্দের তৃতীয় তালিকায় রাখতে পারেন ভাটিয়ারী লেক ও সানসেট পয়েন্ট। এই দুটি স্পট সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত। সীতাকুণ্ড সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ভাটিয়ারী বাজার। সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশাযোগে শুরুতেই আপনি যেতে পারেন ভাটিয়ারী হ্রদে। সেখানে কিছুক্ষণ নৌকা ভ্রমণ করে আপনি ফিরে আসবেন সেনাবাহিনী পরিচালিত সানসেট রেস্তোরাঁয়। রেস্তোরাঁটি পাহাড়ের টিলায়। সেখান থেকেও সুন্দর সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায়।

সীতাকুণ্ড হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি ও সি বিচ আবাসিক হোটেলের মালিক খাইরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সাগর পাহাড় একসঙ্গে দেখার নিরাপদ পর্যটন কেন্দ্র সীতাকুণ্ড। অনায়াসে যে কেউ সীতাকুণ্ড ভ্রমণ করে যেতে পারবেন কম খরচে। এখানে এক দিনের জন্য কিংবা একাধিক দিনের জন্য কম খরচে হোটেল ভাড়া পাওয়া যায়। ফলে বিশ্রাম কিংবা থাকার জন্য কোনো অসুবিধা নেই।