প্রতিটি ভোটকক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন নিয়ে খোদ ইসিই এখন সন্দিহান

নির্বাচন কমিশন ভবন
ফাইল ছবি

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করার পথে ১৪টি চ্যালেঞ্জ বা বাধা চিহ্নিত করেছিল বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এসব বাধা উত্তরণে ইসি নিজেদের কর্মপরিকল্পনায় ১৯টি উপায় উল্লেখ করেছিল। তার একটি প্রতিটি ভোটকক্ষে সিসি (ক্লোজড সার্কিট) টিভি ক্যামেরা স্থাপন। কিন্তু ইসি এখন এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দিহান।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু তা সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের একমাত্র উপায় নয়। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ভোটের মাঠে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি দরকার নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করা। সর্বোপরি মাঠপর্যায়ে ইসির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য।

২০১৪ সালে দেশে ‘একতরফা’ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা বাড়তে থাকে। যেসব নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা হয়, সেখানে অনিয়মের নতুন কৌশল দেখা যায়। ভোটের গোপন কক্ষে (বুথ) ভোটারের বাইরে এক বা একাধিক ব্যক্তি অবস্থান নিয়ে ভোটারকে প্রভাবিত করেন। এর ফলে ভোটার নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন না। বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে এই অনিয়মের চিত্র উঠে আসে। কিন্তু তৎকালীন নির্বাচন কমিশন বিষয়টিকে কখনো আমলে নেয়নি। তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশন এই ‘গোপন বুথের ডাকাতের’ বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়। এটি ঠেকাতে ইসি ভোটকক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের পরিকল্পনা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে খোদ ইসিই এখন সংশয়ে।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সময় গাইবান্ধা-৫ ও ফরিদপুর-২ আসনের উপনির্বাচনে ভোটকক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। এ ছাড়া তারা কুমিল্লা ও রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন, জেলা পরিষদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ভোটকক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করে।

ইসি সূত্র জানায়, এখন তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় নির্বাচন ভবনে বসে নির্বাচন কমিশন মাঠের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। সাধারণত প্রতিটি ভোটকক্ষ ও ভোটকেন্দ্রের বাইরের কিছু এলাকা সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়। এতে প্রতিটি ক্যামেরার পেছনে গড়ে ৪ হাজার ১০০ থেকে ৪ হাজার ৬০০ টাকা করে খরচ হয়।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সময় যেসব ভোটে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে, সেগুলো ছিল তুলনামূলক ছোট এলাকার নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনে একসঙ্গে ৩০০ আসনে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো যাবে কি না, বসানো গেলেও তা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে ইসির মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে।

ইসি সূত্র জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ও বুথের সংখ্যা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনে ৪৫ হাজারের মতো ভোটকেন্দ্র হবে। আর ভোটকক্ষ হবে সোয়া দুই লাখের বেশি। প্রতিটি কক্ষে একটি করে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করতে হলে সোয়া দুই লাখের বেশি ক্যামেরা লাগবে। ভোটকক্ষের বাইরে আরও দুটি করে বসাতে হলে সব মিলিয়ে তিন লাখের বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা প্রয়োজন হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে সিসিটিভি ক্যামেরা পর্যবেক্ষণের জন্য বিপুল জনবল প্রয়োজন হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে স্টেডিয়ামের মতো বড় একটা জায়গা লাগবে। ভোটকেন্দ্রগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের প্রয়োজনীয় কাজও ভোটের অনেক আগে থেকে শুরু করতে হবে। এতে খরচ হবে ১০০ কোটি টাকার বেশি।

নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদসহ গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা ব্যবহার করেছে। এর মাধ্যমে ভোটার, রাজনৈতিক দল, জনপ্রতিনিধিদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে ইসি। সার্বিকভাবে সুফল পাওয়া গেছে। গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে সিসিটিভি ক্যামেরা ব্যবহার করে আমরা অনিয়ম চিহ্নিত করেছি। নির্বাচন স্থগিত করেছি, যা সারা দেশের মানুষ দেখেছে।’

সর্বশেষ ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ছয়টি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন হয় ইভিএমে। তবে এসব আসনের ভোটে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়নি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হবে কি না, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি কমিশন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব ভোটকক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের বিষয়ে আহসান হাবিব বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে সব ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের ইচ্ছা কমিশনের অনেক আগে থেকেই রয়েছে। ৩০০ আসনের প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে কয়েক লাখ সিসিটিভি ক্যামেরা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে এগুলো অপারেট করতে বিশাল কারিগরি টিম দরকার। ক্যামেরা মনিটর করার জন্যও প্রয়োজন অনেক দক্ষ কর্মকর্তা। তাই বিষয়টি কমিশনের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। টেকনিক্যাল সাপোর্টের মাধ্যমে মনিটর করে দোষী ব্যক্তিদের বের করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে কি না, সেটাও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। এ রকম বাস্তবতায় তাঁরা এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কীভাবে করা যায়, তা খতিয়ে দেখছেন।

আহসান হাবিব বলেন, ‘আমাদের সামর্থ্য ও সিসিটিভি ক্যামেরার সুফল—দুয়ের মধ্যে একটি ভারসাম্য আনার চেষ্টা করছি। সে ক্ষেত্রে সবগুলো আসনে বা অতি ঝুঁকিপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলো সিসিটিভি ক্যামেরায় নজরদারি করার বিষয়টি সক্রিয় আলোচনায় রয়েছে। বিষয়টি নির্বাচনের আগেই চূড়ান্ত করবে কমিশন। কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে অবশ্যই অর্থপ্রাপ্তি, জনবল ও মনিটর টিমের সামর্থ্য অর্জন সাপেক্ষে।’

ভোটে সিসিটিভি ক্যামেরার বিষয়টি বেশি আলোচনায় আসে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন ঘিরে। গত বছরের ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়েছিল ইসি। সেখানে প্রায় সব কেন্দ্রেই ব্যাপক অনিয়ম দেখা যায়। গোপন বুথে ভোটার ছাড়া অন্য ব্যক্তিদের অবস্থান করতে দেখা যায়। পরে মাঝপথে এই ভোট বন্ধ করে দেয় ইসি। ইসির এই সিদ্ধান্ত বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউ কেউ ইসির সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করে গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নও তোলা হয় ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে।

গাইবান্ধা-৫ আসনের নির্বাচন বন্ধ করার পর গত ১৯ অক্টোবর সাবেক সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে মতবিনিময় করে বর্তমান কমিশন। সেখানে সাবেক সিইসি ও কমিশনারদের সবাই নির্বাচন বন্ধের সিদ্ধান্ত সঠিক বলে মত দেন। মতবিনিময়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বদলে সিসিটিভির ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দেন।

অবশ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ভিন্নমতও আছে। অনেকে মনে করেন, এসব বিষয়ের (সিসিটিভি ক্যামেরা) আগে নির্বাচনের সময় পুলিশ, প্রশাসন ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ওপর ইসির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নিজেদের নিরপেক্ষ থেকে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, সিসিটিভি ক্যামেরা কোনো সমাধান নয়। সমাধান হলো নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক করা, ইসির নিরপেক্ষ থাকা, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। চোর পাহারা দেওয়া নয়, ইসির কাজ হবে চোর যাতে আসতে না পারে, আগেই তা নিশ্চিত করা। নির্বাচনকালীন সরকার এমন হতে হবে, যারা ইসিকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা দেবে।