চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার সিংহী নোভা নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছে। প্রায় ১০ দিনের বেশি সময় ধরে বন্ধ করে দিয়েছে খাওয়াদাওয়া। এক চোখ ছানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। জটিলতা দেখা দিয়েছে কিডনি ও যকৃতে। ডায়াবেটিস ও অন্যান্য সমস্যা আছে কি না, তা জানার জন্য চলছে নানা পরীক্ষা। বলতে গেলে ওষুধের ওপরেই বেঁচে আছে নোভা। কিন্তু খাওয়াদাওয়া একেবারে বন্ধ করে দেওয়ায় চিকিৎসায় কোনো লাভ হবে না বলে মনে করছে না চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।
নোভার যে শারীরিক অবস্থা, তাতে অচেতন করে চিকিৎসা দেওয়ারও কোনো উপায় নেই। তাই চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর শাহাদাত হোসেনসহ অন্যরা তাঁর কাছে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে নোভা এতটাই দুর্বল যে কে তার গায়ে হাত দিল না দিল, এ নিয়ে যেন কোনো মাথাব্যথা নেই।
সিংহ দম্পতি রাজ-লক্ষ্মীর ঘরে ২০০৫ সালের ১৬ জুন বর্ষা ও নোভার জন্ম হয়। আর ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় ভেটেরিনারি চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন শাহাদাত হোসেন। তাই পেশাজীবনের শুরু থেকেই নোভাকে নিবিড়ভাবেই দেখেছেন তিনি।
শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে আজ রোববার সকালে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি বললেন, ‘নোভা আমাকে চেনে, তার প্রমাণ নাম ধরে ডাক দিলে আমার দিকে তাকাত। আমি একা থাকলে খাঁচার ভেতর থেকে আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করত। আমি খাঁচার নেটের বাইরে থেকে হাত দিয়ে স্পর্শ করার চেষ্টা করতাম। তবে আমার সঙ্গে অন্য কাউকে দেখলে বিরক্ত হতো (নোভা)। ভাবত, চিকিৎসা দেওয়ার জন্য সবাই গিয়েছে।
২০১৪ সালে নোভার বয়স ছিল ৮ বছরের কিছু বেশি। সে সময় তাঁর সে কী তর্জনগর্জন ছিল। গায়ে হাত দেওয়ার কথা তো চিন্তাও করা যেত না। চিৎকার চেঁচামেচি করে অবস্থান জানান দিত।
এখন আমি বা আমরা কয়েকজন নোভার একদম কাছে যাচ্ছি। যদিও ভয়ে ভয়েই যেতে হচ্ছে। সে একটা থাবাও যদি বসায়, তাহলেও আমাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, নোভার এমন অবস্থা মানতে কষ্ট হয়। কিন্তু নোভার বার্ধক্য তো এড়ানো সম্ভব নয়।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় নোভা ১৮ বছরের বেশি সময় ধরে দর্শনার্থীদের বিনোদন দিয়েছে বলে জানালেন শাহাদাত হোসেন। সঙ্গে জানালেন, সিংহের স্বাভাবিক জীবনকাল সাধারণত ১৫ থেকে ১৭ বছর।
নোভা আমাকে চেনে, তার প্রমাণ নাম ধরে ডাক দিলে আমার দিকে তাকাত সে। আমি একা থাকলে খাঁচার ভেতর থেকে আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করত।শাহাদাত হোসেন, ডেপুটি কিউরেটর, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা।
শাহাদাত হোসেন নোভার পিঠে হাত দিয়ে ডাকছেন। নোভার মুখটা তোয়ালে দিয়ে ঢাকা ছিল, সেটি তিনি সরিয়ে দিচ্ছেন—এমন একটি ছোট ভিডিও ফুটেজ ফেসবুকে পোস্ট করেছেন তিনি। বললেন, নোভাকে অনেকেই চেনেন। তাঁর শারীরিক অবস্থা জানতে চান। তাই ছোট ভিডিওটি পোস্ট করেছেন। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ২০০৫ সালে নোভা ও বর্ষার জন্মের কিছুদিন পর ‘বাবা’ রাজ মারা যায়। এর তিন বছর পর ২০০৮ সালে মারা যায় ‘মা’ লক্ষ্মীও। প্রায় ১১ বছর নিঃসঙ্গ থাকার পর নোভার জন্য ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর প্রাণী বিনিময় প্রক্রিয়ায় রংপুর চিড়িয়াখানায় বর্ষাকে পাঠিয়ে সেখান থেকে আনা হয় সিংহ ‘বাদশাহ’কে। বাদশাহর বয়স তখন ১৩ বছর। চট্টগ্রামে আসার পর বাদশাহর নাম নোভার নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয় ‘নভো’। ২০২২ সালে ১৯ বছর বয়সে নভো বার্ধক্যের কারণে মারা গেলে নোভা আবারও নিঃসঙ্গ হয়ে যায়।
বার্ধক্যের কারণে নোভা এক বছর ধরেই অসুস্থ। পেছনের পা গত ছয় মাস ধরে প্যারালাইসিসের মতো হয়ে আছে। আগের চেয়ে খাওয়াদাওয়াও কমিয়ে দিয়েছিল বেশ। একসময় ১২০ কেজি ওজনের নোভা প্রতিদিন ৫ কেজি করে মাংস খেত। আগে নোভার তেমন কোনো অসুস্থতা ছিল না। কিন্তু এক বছর ধরে নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। তাই নোভাকে চিড়িয়াখানার দর্শনার্থীরা আর দেখতে পাচ্ছেন না।
নোভার বোন বর্ষা কেমন আছে, জানতে চাইলে শাহাদাত হোসেন বললেন, রংপুর চিড়িয়াখানায় বর্ষাও বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছে।
পেশাগত কারণে শাহাদাত হোসেনকে কুমির, বাঘসহ অন্যান্য হিংস্র প্রাণীর কাছে যেতে হয়। এর আগে চিড়িয়াখানায় বাঘ রাজ-জয়ার সংসারে ২০২০ সালের ১৪ নভেম্বর তিনটি শাবক জন্ম নেয়। জন্মের পরপরই মারা যায় দুটি শাবক। আরেকটিকে দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেয় জয়া। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ এই শাবকটিকে পেলেপুষে বড় করে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখা হয় ‘জো বাইডেন’। জন্মের পর থেকে সাড়ে পাঁচ মাস জো বাইডেনকে ফিডারে করে দুধ খাওয়ানো, খেলা করাসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন শাহাদাত হোসেন।
আলাপে শাহাদাত হোসেন আবার ফিরলেন নোভার প্রসঙ্গে। বললেন, প্রকৃতির নিয়মে নোভা মারা যাবে। এরপরের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নোভা মারা যাওয়ার পর ময়নাতদন্ত করা হবে। মাটিচাপা দেওয়ার আগে চামড়াটা সংরক্ষণ করা হবে। ভবিষ্যতে চিড়িয়াখানায় জাদুঘর হলে সেখানে নোভার চামড়াটা রাখা হবে। দর্শনার্থীরা নোভার ইতিহাসটা জানতে পারবেন।
নোভাকে নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে শাহাদাত হোসেন ফেসবুকে লিখেছেন, চাকরির শুরু থেকে সব সময় চাইতেন নোভার সঙ্গে ছবি তুলতে। এখন বার্ধক্যের কারণে নোভার বিভিন্ন অঙ্গ কাজ করছে না। এখন গায়ে হাত দেওয়া যাচ্ছে, কাছে যাওয়া যাচ্ছে। কিছুটা কষ্ট নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘এ রকমভাবে কাছে আসতে চাইনি...আশা করি হঠাৎ অহংবোধে লাগবে আর আমাকে দৌড়ানি দেবে। আমি কোনো রকমে খাঁচা থেকে পালাব। আর আগের মতো ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকাবে...আহারে বার্ধক্য!’