সরকার ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দিলে তা কমানো যাবে এবং তাতে কোম্পানিগুলোর লাভও নিশ্চিত করা সম্ভব।
বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ চলে যায় ওষুধের পেছনে। বিপর্যয়মূলক চিকিৎসা ব্যয়ের অন্যতম কারণ ওষুধ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবার জন্য ওষুধ সহজলভ্য না হলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্ভব নয়।
মানুষের চিকিৎসা ব্যয় হয় মূলত হাসপাতাল, চিকিৎসকের চেম্বার, রোগনির্ণয় বা পরীক্ষা–নিরীক্ষা, ওষুধ এবং কিছু চিকিৎসাসামগ্রীর (চশমা, ক্রাচ ইত্যাদি) পেছনে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ জাতীয় স্বাস্থ্য হিসাবে (ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস) দেখা যায়, মানুষ নিজের পকেটের ১০ দশমিক ১ শতাংশ খরচ করে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে, চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বারে ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ, রোগনির্ণয় পরীক্ষা–নিরীক্ষায় ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, ওষুধে ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ এবং চিকিৎসাসামগ্রীতে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ; অর্থাৎ চিকিৎসার জন্য অন্য সব খাতে যে খরচ হয়, তার প্রায় দ্বিগুণ খরচ হয় শুধু ওষুধের পেছনে।
বিশেষজ্ঞদের বড় একটি অংশের মত, দীর্ঘস্থায়ী রোগ, বিশেষ করে ক্যানসার বা কিডনি রোগের চিকিৎসায় মানুষকে লম্বা সময় ধরে খরচ চালিয়ে যেতে হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, অনেক পরিবারের এ ধরনের রোগের খরচ দীর্ঘ সময় ধরে বহন করার সামর্থ্য নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসা খরচ মেটাতে গিয়ে দেশে প্রতিবছর বহু পরিবার বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ ওষুধ। নিয়মিত ওষুধের খরচ মেটাতে অনেক পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়, অনেকে নিঃস্ব হয়ে হয়ে যায়।
ওষুধের বিষয়গুলো আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছি। আমরা নিশ্চিত যে ওষুধের দাম কমলে মানুষের চিকিৎসা ব্যয় অনেক কমে আসবে।মো. সায়েদুর রহমান, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী
এই পরিপ্রেক্ষিতে আজ বৃহস্পতিবার সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস পালিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট পৃথক দুটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল কথা, প্রত্যেক মানুষ প্রয়োজনের মুহূর্তে মানসম্পন্ন সেবা পাবে, সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে অর্থ কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
বিশিষ্ট ওষুধবিজ্ঞানী ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ বা ইউএইচসি) সম্ভব হবে, যদি ওষুধের প্রাপ্যতা সর্বজনীন করা সম্ভব হয়; অর্থাৎ সব মানুষ প্রয়োজনের সময় সব ওষুধ পাবে—রাষ্ট্রকে এমন ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার আলোচনায় ওষুধকে গুরুত্ব দিতে হবে।
ওষুধ তৈরির একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল)। এই প্রতিষ্ঠান প্রধানত অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় থাকা ওষুধ উৎপাদন করে। এ তালিকায় এখন ২১৯টি ওষুধ আছে। ইডিসিএলের ওষুধ সরকারি হাসপাতালে বিতরণ করা হয়, এই ওষুধ বিক্রি হয় না। এ তালিকায় আরও ওষুধ অন্তর্ভুক্ত করা হলে মানুষ বেশি ওষুধ বিনা মূল্যে পাবে।
ওষুধে বাংলাদেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রয়োজনের ৯৫ শতাংশ ওষুধ এখন দেশেই তৈরি হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব ওষুধ তৈরি করে, তাদের সব কটির মূল্য নিয়ন্ত্রণ সরকার করে না। একই ওষুধ বিভিন্ন কোম্পানি ভিন্ন ভিন্ন মূল্যে বিক্রি করে। কিছু ক্ষেত্রে দামের পার্থক্য অনেক। কিন্তু সরকার ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দিলে তা কমিয়ে আনা যাবে এবং তাতে কোম্পানিগুলোর লাভও নিশ্চিত করা সম্ভব।
প্রয়োজনের ৯৫ শতাংশ ওষুধ এখন দেশেই তৈরি হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব ওষুধ তৈরি করে, তাদের সব কটির মূল্য নিয়ন্ত্রণ সরকার করে না।
প্রচার ও বিপণনের পেছনে ওষুধ কোম্পানিগুলো অনেক ব্যয় করে। সেই ব্যয় যুক্ত হয় ওষুধের দামে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টের ফোকাল পারসন সুব্রত পাল প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি সব প্রতিষ্ঠানে একটি করে ২৪ ঘণ্টা খোলা ফার্মেসি চালু করতে হবে। এসব ফার্মেসিতে বেসরকারি কোম্পানির ওষুধও বিক্রি হবে। কোনো ব্যক্তি ব্যবস্থাপত্র দেখিয়ে ওষুধ কিনতে চাইলে কিছু মূল্যছাড়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে ইডিসিএলকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা বড় করারও পদক্ষেপ নিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘ওষুধের বিষয়গুলো আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছি। আমরা নিশ্চিত যে ওষুধের দাম কমলে মানুষের চিকিৎসা ব্যয় অনেক কমে আসবে।’