বাংলাদেশ থেকে যত আলু রপ্তানি হয়, তার ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ যায় চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে
বাংলাদেশ থেকে যত আলু রপ্তানি হয়, তার ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ যায় চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে

‘গায়েবি’ রপ্তানি, আলুতে আত্মসাৎ ৩০ কোটি টাকা

  • এনবিআরের রপ্তানির হিসাবের সঙ্গে উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্রের হিসাবে বিস্তর ফারাক।

  • ১০টির জালিয়াতি শনাক্ত। আরও ৪৮টির বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যভান্ডারের হিসাবে ২০২০ সালে আলু রপ্তানিতে তৃতীয় শীর্ষ অবস্থানে ছিল রাজধানীর মতিঝিলের অন্তরা করপোরেশন। ওই বছর প্রতিষ্ঠানটি ৯৬টি চালানে প্রায় ৩৭ কোটি টাকা মূল্যের ১৫ হাজার ৫৮৮ মেট্রিক টন আলু রপ্তানি করে।

অবশ্য চট্টগ্রাম কাস্টমস তদন্ত করে প্রমাণ পেয়েছে, আসলে অন্তরা করপোরেশন একটি আলুও রপ্তানি করেনি। বরং জাল নথিপত্র জমা দিয়ে সরকারের কাছ থেকে তারা আলু রপ্তানির বিপরীতে সাড়ে সাত কোটি টাকা নগদ সহায়তা নিয়েছে।

অন্তরা করপোরেশনের মতো ১০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত করে চট্টগ্রাম কাস্টমস জানতে পেরেছে, এসব প্রতিষ্ঠান ৪২২টি চালানে ১ কোটি ৯১ লাখ মার্কিন ডলারের (প্রায় ১৬৪ কোটি টাকা) আলু রপ্তানি দেখিয়েছে, যা পুরোটাই ছিল ‘গায়েবি’। কোনো রপ্তানি না করেই তারা সরকারের কাছ থেকে ৩০ কোটি টাকার বেশি নগদ সহায়তা নিয়ে আত্মসাৎ করেছে।

রপ্তানির আলু কনটেইনারে ভরার আগে নমুনা পরীক্ষা করে স্বাস্থ্যসনদ দিই আমরা। বাস্তবে কত আলু রপ্তানি হয়েছে, তা এই স্বাস্থ্যসনদ দেওয়ার পর হিসাব করে তথ্য প্রকাশ করা হয়। এখানে ভুল হওয়ার আশঙ্কা নেই।
মোহাম্মদ শাহ আলম, উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্রের চট্টগ্রামের উপপরিচালক

‘গায়েবি’ আলু রপ্তানির বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের মধ্যে। দীর্ঘ সময় ধরে তদন্ত করে চট্টগ্রাম কাস্টমস গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে ১০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আরও ৪৮টির বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। কাস্টমসের কর্মকর্তারা বলছেন, পুরো তদন্ত শেষ হলে আরও জালিয়াতি ও আরও বিপুল অর্থ আত্মসাতের তথ্য বেরিয়ে আসবে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপকমিশনার মো. বদরুজ্জামান মুন্সী প্রথম আলোকে বলেন, তাদের ২০টি দল জালিয়াতি নিয়ে তদন্ত করছে। যে কয়েকটির তদন্ত শেষ হয়েছে, সেসব রপ্তানিকারকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। ‘গায়েবি’ রপ্তানির ক্ষেত্রে আলুকে কেন বেছে নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আলু রপ্তানিতে সরকার ২০ শতাংশ সহায়তা দেয়। এ ক্ষেত্রে হয়তো জালিয়াতিতে ঝুঁকি কম মনে করেছে চক্রটি।

রপ্তানির ‘অর্ধেকই গায়েবি’

অপ্রচলিত বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে সরকার নগদ সহায়তা দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪৩টি পণ্য নগদ সহায়তা পাচ্ছে। সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা পাওয়া পণ্যের একটি আলু। মানে হলো, কোনো প্রতিষ্ঠান ১০০ টাকার আলু রপ্তানি করলে ২০ টাকা সরকার ভর্তুকি দেয়।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ৫ কোটি ৮ লাখ ডলারের আলু রপ্তানি হয়, যা তখনকার মূল্যে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৩৭ কোটি টাকার সমান।

বাংলাদেশ থেকে যত আলু রপ্তানি হয়, তার ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ যায় চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে। সেখানে বেসরকারি ডিপোতে (পণ্য রাখার জায়গা) আলু কনটেইনারে ভরা হয়। তখন আলুর নমুনা পরীক্ষা করে স্বাস্থ্যসনদ দেয় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্র।

‘গায়েবি’ আলু রপ্তানির বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের মধ্যে। দীর্ঘ সময় ধরে তদন্ত করে চট্টগ্রাম কাস্টমস গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে ১০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আরও ৪৮টির বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।

উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্রের রপ্তানির হিসাবের সঙ্গে চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যে ব্যাপক গরমিল পাওয়া গেছে। যেমন এনবিআরের হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে শুল্কায়নের পর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়েছে ১ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫৫ টন আলু। তবে উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্রের হিসাবে, তারা ৫১ হাজার ৪৪৫ টন আলু রপ্তানির সনদ দিয়েছে।

২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত চার অর্থবছরে এনবিআরের তথ্যের সঙ্গে উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্রের রপ্তানির হিসাবের পার্থক্য ৫৯ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই ৫৯ শতাংশ রপ্তানি আসলে ‘গায়েবি’। চট্টগ্রাম কাস্টমস ২০২০-২১ অর্থবছরের আলু রপ্তানি বিষয়ে তদন্ত করে এখন পর্যন্ত ৩৭ শতাংশ রপ্তানি ‘গায়েবি’ বলে শনাক্ত করেছে।

উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্রের চট্টগ্রামের উপপরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রপ্তানির আলু কনটেইনারে ভরার আগে নমুনা পরীক্ষা করে স্বাস্থ্যসনদ দিই আমরা। বাস্তবে কত আলু রপ্তানি হয়েছে, তা এই স্বাস্থ্যসনদ দেওয়ার পর হিসাব করে তথ্য প্রকাশ করা হয়। এখানে ভুল হওয়ার আশঙ্কা নেই।’

এমন ঘটনা সামগ্রিক কৃষিপণ্যের রপ্তানি নিয়ে ভুল বার্তা দিচ্ছে। কারণ, রপ্তানি না করে নথিপত্রে নাম ওঠানোয় মনে হবে, দেশে পর্যাপ্ত আলু রয়েছে। এ ধরনের তথ্য সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি

মৃত মানুষের সইয়ে রপ্তানি

আলু রপ্তানিতে জালিয়াতির তদন্ত করতে গিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমসের কর্মকর্তারা আশ্চর্যজনক নানা ঘটনা পেয়েছেন। যেমন ‘গায়েবি’ রপ্তানি তথ্যভান্ডারে দেখাতে কাস্টমস কর্মকর্তাদের পরিচয় (আইডি ও পাসওয়ার্ড) ব্যবহার করেছে জালিয়াত চক্র। ব্যবহার করা হয়েছে মৃত মানুষের সইও।

অন্তরা করপোরেশন ছাড়াও জালিয়াতি করে রুচিকর অ্যাগ্রো ফুড প্রোডাক্টস ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা, টাচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা, তাসা ওয়ার্ল্ড বিডি এক্সপো সাড়ে ৩ কোটি টাকা, ম্যাজিস্টিক এন্টারপ্রাইজ ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, এমবি অ্যাগ্রো ফুড প্রোডাক্ট ৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা, মিয়াজী ফুড প্রোডাক্টস ৫ কোটি টাকা, এম আর ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল ২ কোটি ১৮ লাখ টাকা, কাশ্মেরি অ্যাগ্রো ফুড ৪৫ লাখ টাকা এবং আফান ফুড ৯১ লাখ টাকা নগদ সহায়তা নিয়েছে।

অন্তরা করপোরেশনের জালিয়াতি নিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমসের ছয় সদস্যের কমিটি ৭৫ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় গত বছরের ২৯ অক্টোবর। তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে ৪ হাজার ১৫ পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্য ও দলিলাদি যুক্ত করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, কাস্টমস কর্মকর্তাদের আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে এনবিআরের তথ্যভান্ডারে (অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম) অন্তরা করপোরেশনের আলু রপ্তানি দেখানো হয়েছে। এমনকি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার ২২ দিন পর এক কাস্টমস কর্মকর্তার সই ব্যবহার করা হয়েছে রপ্তানি নথিতে।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অন্তরা করপোরেশন সংশ্লিষ্ট সময়ে প্রায় ৪৭ লাখ মার্কিন ডলারের রপ্তানি আয় ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে এনেছে, যদিও রপ্তানি করেনি। রপ্তানি না হলেও আয় আসে কীভাবে, সে বিষয়ে সন্দেহের কথাও তদন্ত প্রতিবেদনে তুলে ধরেছেন কর্মকর্তারা। বলা হয়েছে, দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার করে আবার ফেরত আনা হতে পারে। এতে যেমন কালোটাকা সাদা হয়, তেমনি ২০ শতাংশ নগদ সহায়তাও পাওয়া যায়।

অন্তরা করপোরেশনের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে ঢাকার মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার ১২-১৩ নম্বর ভবনের (রহমান চেম্বার) ষষ্ঠ তলা। সোমবার বেলা তিনটার দিকে সেখানে গেলে জানানো হয় অন্তরা করপোরেশনের মালিক মো. মুশতাক খান কার্যালয়ে নেই। এক কর্মী মুঠোফোনে তাঁর (মুশতাক) সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন।

মুশতাক খান বলেন, কাস্টমসের অভিযোগ ভিত্তিহীন। রপ্তানি করেই রপ্তানি আয় দেশে আনা হয়েছে। মারা যাওয়ার ২২ দিন পর কর্মকর্তার স্বাক্ষর ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা কাস্টমস বলতে পারবে। তারা কেন, কীভাবে করেছে, সেটা তো আর আমি বলতে পারব না।’

মিয়াজী ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের ৬৩টি চালানের সাড়ে ৩২ লাখ ডলারের রপ্তানিকে ‘গায়েবি’ বলছে চট্টগ্রাম কাস্টমস। তাদের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে মতিঝিলের শাপলা ভবনে। রোববার দুপুরে গিয়ে পাওয়া যায় প্রতিষ্ঠানটির মালিক মামুন মিয়াজিকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানি না করে নগদ সহায়তা পাওয়ার সুযোগ নেই। তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য সঠিক নয়। তিনি বলেন, তিনি এখন আর কোনো পণ্যই রপ্তানি করছেন না। ফল, আদা, পেঁয়াজসহ অন্যান্য পণ্য আমদানির চেষ্টা করছেন।

জালিয়াতির দায়ে অভিযুক্ত আরেক প্রতিষ্ঠান আফান ফুডের ঠিকানা মতিঝিলের খান ম্যানশনে। রোববার বিকেলে ভবনটিতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ভবনটির একজন নিরাপত্তারক্ষী বলেন, আগে কোম্পানিটি ওই ভবনে ছিল। এখন আর নেই।

‘গায়েবি’ রপ্তানির গন্তব্য সংযুক্ত আরব আমিরাত

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তদন্তে যেসব ‘গায়েবি’ রপ্তানি শনাক্ত হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগের গন্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে সংযুক্ত আরব-আমিরাত ও মালয়েশিয়া। যেমন ২০২০-২১ অর্থবছরে ‘গায়েবি’ রপ্তানির ৬৪ শতাংশ আলুর গন্তব্য দেখানো হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতকে। প্রায় ২৫ শতাংশের গন্তব্য ছিল মালয়েশিয়া।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পাচার করা অর্থের নতুন গন্তব্য হয়ে উঠেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শহর দুবাই। দুবাই চেম্বারের হিসাবে, সেখানে বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন কোম্পানি সংখ্যা ১০ হাজার ৯৭৫। অভিযোগ আছে, কেউ কেউ কাগুজে কোম্পানি খুলে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। মালয়েশিয়ায়ও বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে।

আলুর আগে মুড়ি, সুপারি, মসলা, তৈলবীজসহ বিভিন্ন পণ্যের ‘গায়েবি’ রপ্তানি দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। সরকার নানা পণ্যে বছরের পর বছর নগদ সহায়তা দিয়ে গেলেও রপ্তানি আয় খুব একটা বাড়ছে না। বরং জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, এমন ঘটনা সামগ্রিক কৃষিপণ্যের রপ্তানি নিয়ে ভুল বার্তা দিচ্ছে। কারণ, রপ্তানি না করে নথিপত্রে নাম ওঠানোয় মনে হবে, দেশে পর্যাপ্ত আলু রয়েছে। এ ধরনের তথ্য সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি বলেন, এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, যাতে সামনে এই ধরনের ঘটনা আর না ঘটে।

[প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়েছেন আরিফুর রহমানআহমদুল হাসান, ঢাকা]