বিশ্লেষণ

নদীর সংজ্ঞা নির্ধারণ করা কেন জরুরি

নদীর সংজ্ঞা ও সংখ্যা নির্ধারণ করেছে নদী কমিশন। এই উদ্যোগের ফলে দেশে কোনটি নদ–নদী, কোনটি নয়, সেটি নির্ধারণ সহজ হবে। নদ–নদী দখলমুক্ত রাখায় ও সম্পদ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গত আগস্টে তাদের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের নদ–নদীর সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। তাদের খসড়া তালিকা অনুযায়ী, দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৯০৭টি। কমিশন এ–ও বলেছিল, এটা চূড়ান্ত তালিকা নয়। নদ-নদীর সংখ্যা, নাম, দৈর্ঘ্য ইত্যাদি নিয়ে কারও আপত্তি থাকলে ২৭ আগস্টের মধ্যে তিনি কমিশনকে জানাতে পারবেন।

কমিশন সূত্র বলছে, ওই সময়ের মধ্যে মাত্র ১০ জন তাঁদের মতামত বা বক্তব্য কমিশনকে জানিয়েছিলেন। তারপরও কমিশন ৬৪ জেলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে মতামত, বক্তব্য ও তথ্য জানতে চিঠি দিয়েছিলেন। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ নির্ধারিত সময়ের পর রংপুর অঞ্চলের নদ-নদী নিয়ে কমিশনকে একটি তালিকা দিয়েছিলেন।

এতে তিনি বলেছিলেন, কমিশনের তালিকা থেকে ১০৫টি নদীর নাম বাদ পড়েছে। কমিশন এসব বক্তব্য আমলে নিয়ে ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নদী দিবসে একটি তালিকা প্রকাশ করে। তাতে বলা হচ্ছে, দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ১ হাজার ৮টি। তবে তারা বলেছে, এটিও চূড়ান্ত তালিকা নয়। যৌক্তিক তথ্য-উপাত্ত পেলে এই সংখ্যায়ও পরিবর্তন আসতে পারে।

‘আমরা কর্মশালায় নদীর সংজ্ঞার যথার্থতা নিয়ে আলোচনা করেছি, সংজ্ঞাটি পরীক্ষা করেছি। দৈবচয়নের ভিত্তিতে কয়েকটি নদী সংজ্ঞায় পড়ে কি না, তা মাঠ পর্যায়ে যাচাই করে দেখেছি।’
মনজুর আহমেদ চৌধুরী, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন খসড়া তালিকা প্রকাশের পর এই প্রতিবেদকের সঙ্গে নদী ও পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাতের কথা হয়। তিনি বলছিলেন, নদীর সংখ্যা কত, তা বলতে গেলে আগে ঠিক করতে হবে নদী কাকে বলে। নদীর সংজ্ঞা স্থির করা না হলে নদীর সংখ্যাও ঠিক করা যাবে না।

কমিশন বলছে, নদীর সংজ্ঞা ঠিক করতে ২০২২ সালে তারা উদ্যোগ নিয়েছিলেন, একাধিক কর্মশালা করেছিলেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ছাড়াও এসব কর্মশালায় নদী বিশেষজ্ঞ, পানি বিশেষজ্ঞ, আইন বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কর্মশালা থেকে একটি সংজ্ঞা ঠিক করা হয়েছে। এই সংজ্ঞার বাইরে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কোনো জলাধার বা জলধারাকে নদী বলে গণ্য করবে না।

নদী কাকে বলে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান, কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাসের বড় জায়গাজুড়ে আছে নদী। তাঁর ‘নদী’ কবিতা মূলত নদীর জন্ম, জীবন ও শেষ পরিণতির একটি দীর্ঘ বর্ণনা। পাহাড়ে সাদা বরফ আর রাশি রাশি মেঘের রাজ্যে নদীর জন্ম হয়। বরফ গলে জল হয়ে নদী ওপর থেকে নুড়ি-পাথর সঙ্গে নিয়ে নিচে নামে।

পাহাড় ছেড়ে নদী নেমে পড়ে সমতলে। বাংলাদেশের নদীর দুই তীরে যা কিছু আছে, কবিতার এই অংশে তার অপূর্ব বর্ণনা পাওয়া যায়। ‘কত মেয়েরা নাহিছে ঘাটে,/ কত ছেলেরা সাঁতার কাটে,/ কত জেলেরা ফেলিছে জাল,/ কত মাঝিরা ধরেছে হাল,/ সুখে সারিগান গায় দাঁড়ি,/ কত খেয়া-তরী দেয় পাড়ি।’ ডানে-বাঁয়ে অসংখ্য গ্রাম-বন্দর-বাজার রেখে নদী চলে, কোথাও থেমে যায় না। সবশেষে মেশে সাগরে। ‘এখন কোথাও হবে না যেতে,/ সাগর নিল তারে বুক পেতে।’ বাংলাদেশের নদী বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ মনে করে, এই কবিতায় যা পাওয়া যায়, তাই–ই নদী।

নদীর সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা পাওয়া যায় কঠিন। কে বা কারা নদীর সংজ্ঞা দিয়েছে, সেই সূত্র পাওয়াও দুষ্কর। অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধান বলছে, নদী হচ্ছে প্রাচুর্যপূর্ণ (কপিয়াস) প্রাকৃতিক জলধারা, যা একটি খাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাগরে বা হ্রদে যায়।

এই সংজ্ঞার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। প্রথমত ‘প্রাচুর্যপূর্ণ’ শব্দটিতে ব্যাখ্যাসাপেক্ষ, এর অর্থ সবার কাছে সমান নয়। এই সংজ্ঞায় সব নদী অন্তর্ভুক্ত হয় না। যেমন তীব্র হিম অঞ্চলে দীর্ঘ সময় বা বছরের নির্দিষ্ট সময়জুড়ে নদী প্রবহমান থাকে না। পানি বরফ হয়ে জমাট বেঁধে থাকে। মরুভূমির নদীর চরিত্র আবার কিছুটা ভিন্ন। সব দেশের সব মানুষের কাছে নদী একই অর্থ বহন করে না।

সাম্প্রতিক কালে দখল–দূষণে নদীর আইনগত গুরুত্ব বেড়ে গেছে। একাধিক দেশের আদালত নদীকে জীবন্ত সত্তার স্বীকৃতি দিয়েছে। তার অর্থ হচ্ছে, মানুষের যেমন জীবন আছে, নদীরও তেমনি জীবন আছে। মানুষের জীবন ও বসতি নদীর মুখাপেক্ষী। নদীর ক্ষতি মানে তাই জীবনেরই ক্ষতি।

নদীর নাম

নদী ছোট হয়, নদী অনেক দীর্ঘও হয়। এক শ মিটারের কম দৈর্ঘ্যের যেমন নদী আছে, তেমনই হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ নদীও আছে। একই নদী দুই দেশে প্রবাহিত হয়ে দুই নামে পরিচিতি পায়। যেমন একই নদী ভারতে গঙ্গা আর বাংলাদেশে পদ্মা।

গঙ্গা নদী ফারাক্কা বাঁধের কাছে এসে পদ্মা হয়েছে। ফারাক্কা থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে গঙ্গা নদী পদ্মা নাম নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। এরপর রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী হয়ে গোয়ালন্দ-দৌলতদিয়া-আরিচা পৌঁছেছে। নদিটি এখানে পদ্মার সঙ্গে এসে মিশেছে যমুনা। এর পর পদ্মা-যমুনার মিলিত ধারাও পদ্মা নাম নিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। পদ্মা চাঁদপুরে গিয়ে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। মিলিত এই ধারা বয়ে চলেছে মেঘনা নামে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আরিচা পর্যন্ত নদীর নাম নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে। কেউ কেউ এই অংশকে গঙ্গা বলতে আগ্রহী। এর পেছনে রাজনীতি আছে। গঙ্গার পানির ভাগাভাগি নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি আছে। বাংলাদেশ অংশে নদীর নাম গঙ্গা না থাকলে গঙ্গাচুক্তি বাতিল হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

অন্যদিকে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজবাড়ীর কাছে এই নদীর পানি আটকে ‘গঙ্গা ব্যারাজ’ নামে জলাধার তৈরির পরিকল্পনা করেছিল। তখনো নদীর এই অংশের নাম গঙ্গাই ছিল। তবে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন এই অংশকে গঙ্গা নয়, পদ্মাই বলছে। কমিশন বলছে, পদ্মা বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদী। এর দৈর্ঘ্য ৩৪১ কিলোমিটার।

খাল নিয়ে যত সমস্যা

নদীর মতো খালও জলধারা। সেগুলোও বয়ে চলে এক জায়গা থেকে অন্যত্র। তাই বলে নদী আর খাল এক নয়। তাদের বৈশিষ্ট্য আলাদা। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বা সুন্দরবন অঞ্চলে অনেক খাল আছে, যা দৈর্ঘ্য–প্রস্থে উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু নদীর চেয়েও বড়। নদীর সংখ্যা ঠিক করতে হলে নদীকে খাল থেকে আলাদা করতে হবে।

কমিশন বলছে, তারা দেশে খালের সংখ্যা ও সেগুলো কী অবস্থায় আছে—তাও বের করার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে তারা সারা দেশের ভূমি কার্যালয়ের সহায়তা নিচ্ছে।

কমিশনের সংজ্ঞা

একাধিক কর্মশালার পর কমিশন দেশের নদ-নদীর একটি সংজ্ঞা তৈরি করেছে। সেটি এ রকম: ‘নদ বা নদী বলিতে পাহাড়, পর্বত, হিমবাহ, হ্রদ, ঝরনা, ছড়া, অন্য কোনো জলাশয় বা অন্য কোনো জলাধার হইতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হইয়া যে জলধারা সারা বছর বা বছরের কোনো কোনো সময় দুই তীরের মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হইয়া সমুদ্র, মহাসমুদ্র, হ্রদ, অন্য কোনো জলাশয় বা অন্য কোনো জলাধারে পতিত হয় তাহাকে বুঝায়। তবে শর্ত থাকে, উপর্যুক্ত সংজ্ঞায় যাহাই থাকুক না কেন ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে, রিভিশনাল সার্ভে ও বাংলাদেশ রিভিশনাল সার্ভে রেকর্ডে নদ বা নদী যাহা উল্লেখকৃত হইয়াছে, তাহা নদ বা নদী হিসাবে গণ্য হইবে।’

কমিশন বলছে, এই সংজ্ঞাকে আইনে পরিণত করতে তারা উচ্চমহলে চিঠি দিয়েছে।

সংজ্ঞায় স্পষ্ট দুটি অংশ দেখা যাচ্ছে। প্রথম অংশে আছে নদীর প্রাকৃতিক চরিত্র। দ্বিতীয় অংশে আছে নদীর আইনগত ভিত্তি। সংজ্ঞার প্রথম অংশের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নদী কবিতার বা অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানের দেওয়া সংজ্ঞার কিছু মিল আছে। দ্বিতীয় অংশটি নদীর অস্তিত্বের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।

কমিশন আদালতের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিয়েছে। হাইকোর্টে একটি রিট মামলার (মামলা নং ৩৫০৩/২০০৯) রায়ে বলা হয়েছে, সিএস ম্যাপে যে স্থানে নদী দেখানো হয়েছে, সেই স্থানকেই নদী বলে আপাত স্বীকৃতি দিতে হবে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কর্মশালায় নদীর সংজ্ঞার যথার্থতা নিয়ে আলোচনা করেছি, সংজ্ঞাটি পরীক্ষা করেছি। দৈবচয়নের ভিত্তিতে কয়েকটি নদী সংজ্ঞায় পড়ে কি না, তা মাঠ পর্যায়ে যাচাই করে দেখেছি।’

তালিকা হলো কীভাবে

নদীর সংজ্ঞা ও নদ-নদীর তালিকা তৈরির প্রক্রিয়ার শুরু থেকে যুক্ত ছিলেন কমিশনের সাবেক উপপরিচালক মো. আখতারুজ্জামান তালুকদার। বিশ্ব নদী দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ২০১৯ সালের আগস্টে ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসককে একটি নির্দিষ্ট ছকে নিজ নিজ জেলার নদ-নদী, খাল-বিল ও হাওর-বাঁওড়ের তথ্য পাঠাতে বলা হয়। নদ-নদীসহ দেশের সব জমির স্বত্বলিপি (রেকর্ড অব রাইটস) জেলা প্রশাসক সংরক্ষণ করেন।

জেলা প্রশাসকেরা দেশের ৫০০ ইউএনএও/এসি ল্যান্ড এবং ৫ হাজার ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের তথ্য সংগ্রহ করে তা কমিশনে পাঠান। ২০২২ সালে প্রায় সব জেলার তথ্য কমিশনে জমা হয়। এটাই ছিল প্রাথমিক তথ্যের উৎস।

কমিশন নদীর তালিকা তৈরির সময় প্রাথমিক উৎসের তথ্যের সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ছয় খণ্ডের নদ-নদীর তালিকা, সিইজিআইএসের মানচিত্র ও সার্ভে অব বাংলাদেশের নদীসহ প্রশাসনিক মানচিত্রের তথ্য মিলিয়ে বা যাচাই করে নেয়। এরপর চলতি বছরের আগস্টে ছয়টি বাংলা ও দুটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে মতামত চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয় কমিশন।

কী কাজে লাগবে

সংজ্ঞা ও তালিকা তৈরি হলে নদী ব্যবস্থাপনা সহজ হবে। একেকটি উপজেলা বা জেলায় কয়টি নদী আছে, তা সহজে দেখা যাবে। একটি নদী কোথা থেকে শুরু হয়ে কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে তা তালিকা থেকে জানা যাবে। নদী দখলের চেষ্টা হলে বা হারিয়ে গেলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।

নদী দিবসের অনুষ্ঠানে একটি নতুন বিষয় তোলা হয়। বলা হয়, এই উদ্যোগ থেকে ‘রিভার অ্যাকাউন্টিং’ বা ‘নদীসম্পদের হিসাব’ করা যাবে। কয়টি নদী অবৈধ দখল ও দূষণের কবলে পড়েছে, কয়টি দখলমুক্ত হয়েছে, কয়টি দুষণযুক্ত বা দূষণমুক্ত করা হলো—তার হিসাব করা যাবে।

কয়টি নদীর নাব্যতা সংকট আছে এবং কয়টি নদী নাব্য—সেসবের হিসাব করা যাবে। জাতীয় অর্থনীতিতে নদীর অবদান কতটুকু, তা বের করতে এই উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। এ দেশে নদীর সংখ্যার মতো নদী বিশেষজ্ঞের সংখ্যাও অনেক। নদীর দখল–দূষণ যেমন বেড়েছে, তেমনি নদী রক্ষার আন্দোলনও চলছে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের দেওয়া সংজ্ঞায় ও সংখ্যায় সীমাবদ্ধতা হয়তো কিছু আছে। তবে কমিশনের এই উদ্যোগ নদী রক্ষা, নদীর জমি উদ্ধার ও অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে বড় ভূমিকা রাখবে।

দেশের নদ-নদী ‘পাবলিক ট্রাস্ট প্রোপার্টি’ বা ‘জনগণের সম্পত্তি’। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কাজ হচ্ছে এসব নদ–নদী রক্ষা।