সন্তান হারানোর কষ্ট সময়ের সঙ্গে গভীর হয়। মায়ের স্মৃতিতে মৃত সন্তানের হাসি, অভিমান, আবদার, তার বলা একটি সামান্য শব্দও স্মারক হয়ে থাকে। তবে সময় এই হারানো স্মৃতিকে সহনীয় করে তুললে সামনে উপস্থিত হয় সন্তানের মৃত্যুর কারণ।
অশীতিপর মরিয়ম বিবির দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন গত শতকের আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হওয়া নূর হোসেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জে যাওয়ার পথে ছোট্ট নূর অনেকটা পথ হেঁটেছিল মায়ের হাত ধরে। বছর সাত–আটের নূর তখন কোথায় কোথায় দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিয়েছিলেন, ৫৩ বছর পরও মনে করতে পারেন এই মা।
রাজধানীর পুরান ঢাকার বনগ্রামের এক কামরার ঘরে থেকেও নূর হোসেনের দিনলিপি লেখার অভ্যাস, ভালো সিনেমা দেখার শখ, শরীর ঠিক রাখতে নানা কসরতের আগ্রহ দেখে বাবা মজিবুর রহমান বলতেন, ‘এই ঘরে ওরে রাখতে পারুম না, গরিবের ঘরে জন্মায়ে এই পোলা হইছে অন্য রকম।’ বেবিট্যাক্সিচালক মজিবুর রহমান প্রয়াত হয়েছেন ২০০৫ সালে। কিন্তু মৃত সন্তান সম্পর্কে স্বামীর মন্তব্যটুকুও স্মৃতির দেরাজে যত্নে তুলে রেখেছেন মরিয়ম বিবি।
আমার ছেলে ইংরেজি শিখত নিজে নিজে। দিনের ঘটনা সব লিইখ্যা রাখত ডায়রিতে। মারা যাওয়ার আগের রাতে আমার ছেলেটা যে কী লিখছিল, কোনো দিন জানতে পারলাম না। ডিআইটির মসজিদে থাকা ওর ডায়রিটা সরায় ফেলানো হইছিল। তখন স্বৈরাচারের শাসনকাল। অনেক কিছুই সামনে আসতে দেয় নাই। ওর মুখটাই আর দেখি নাই।নূর হোসেনের মা
গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর মিরপুরের মাজার রোডের বাড়িতে কথা হয় নূর হোসেনের মা, দুই ভাই ও একমাত্র বোন শাহানা বেগমের সঙ্গে। মৃত্যুর দিন সকালে এই বোনের জন্য মতিঝিলের এক দোকান থেকে ফল কিনে দিয়েছিলেন নূর। একমাত্র বোন শাহানার জন্য খুব টান ছিল ভাইয়ের।
১৯৮৭ সালের এই দিনে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লেখা স্লোগান নিয়ে মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন নূর হোসেন। মিছিলটি রাজধানীর জিরো পয়েন্ট (বর্তমান শহীদ নূর হোসেন চত্বর) এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ গুলি চালায়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন ২৪ বছরের অপ্রতিরোধ্য যুবক নূর হোসেন। আর সে ঘটনাই যেন ছিল গত শতকের শেষে স্বৈরাচারী সরকার পতন আন্দোলনের সবচেয়ে বড় স্ফুলিঙ্গ। নূর হোসেন হয়ে উঠেছিলেন আন্দোলনের পোস্টার। তিনি নিহত হওয়ার পর ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিক্ষোভের আগুন।
বনগ্রামের মজিবুর রহমান ও গৃহিণী মরিয়ম বিবির সাত সন্তানের একজন নূর হোসেন। দরিদ্র পরিবারে এতগুলো ভাইবোন এক ঘরে থাকা কঠিন ছিল। মেজ ছেলে নূর তখন থাকতেন মতিঝিলের ডিআইটি বিল্ডিংয়ের পাশের মসজিদের এক ঘরে। লেখাপড়া খুব বেশি করেননি। তবে মা মরিয়ম বললেন, ‘আমার ছেলে ইংরেজি শিখত নিজে নিজে। দিনের ঘটনা সব লিইখ্যা রাখত ডায়রিতে। মারা যাওয়ার আগের রাতে আমার ছেলেটা যে কী লিখছিল, কোনো দিন জানতে পারলাম না। ডিআইটির মসজিদে থাকা ওর ডায়রিটা সরায় ফেলানো হইছিল। তখন স্বৈরাচারের শাসনকাল। অনেক কিছুই সামনে আসতে দেয় নাই। ওর মুখটাই আর দেখি নাই।’
মরিয়ম বিবি জানালেন, ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ভোরে ফজরের নামাজ আদায় করে বনগ্রামের বাসা থেকে নূরের বাবা আর তিনি ছুটেছিলেন মতিঝিলে। সেদিন সচিবালয় ঘেরাও করার কথা। মন বলছিল নূর মিছিলে যাবে, বিপদ হতে পারে। তাঁরা গিয়েছিলেন ছেলেকে সাবধান করতে। মরিয়ম বিবি বলছিলেন, ‘গিয়া দেখি ছেলে ঘুমাইতেছে। শরীরের মধ্যে কীসব যেন লেখা। আমাগো দেইখা একটা চাদর গায়ে জড়ায় সামনে আসছে। তখন বুঝি নাই আমার ছেলে জীবন্ত পোস্টার হইছে। অথচ ও আমারে বলছিল, মিছিলের সামনে যাইব না।’
গুলিস্তানের কাছে সেদিন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সবার সামনে ছিলেন নূর হোসেন। এই দৃশ্য তাঁর বড় ভাই দেখে বাড়ি ফিরে বলেছিলেন মায়ের কাছে। এরপর বিকেল থেকে মানুষের মুখে মুখে শোনা যেতে থাকে পুলিশের গুলিতে নূর হোসেনের মৃত্যুর কথা। কিন্তু তখন কোনোভাবেই জানার সুযোগ ছিল না। সন্ধ্যায় বিবিসির খবরে প্রথম নিশ্চিত হওয়া যায়, বনগ্রামের মজিবুর রহমানের ছেলে নূর হোসেনসহ তিনজন নিহত হয়েছেন পুলিশের গুলিতে।
সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে নূর হোসেনের ছোট বোন শাহানা বললেন, ‘সেদিন সন্ধ্যায় (১০ নভেম্বর) পাশের বাসার একজন এসে প্রথম নিশ্চিত করল বিবিসিতে কয়েকবার বলা হয়েছে, আমার ভাইয়ের মৃত্যুর খবর। সেদিন রাতে গোপনে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয় আমার ভাইসহ তিনজনকে। ভাইয়ের শরীরে “স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক” যে লিখেছিল, সে অনেক দিন পালিয়ে ছিল ভয়ে। অনেক বছর পর সেই আকরাম ভাই আমাদের সঙ্গে দেখা করেন। ভাইয়ের বুকে-পিঠে স্লোগান লিখে দেওয়ার ঘটনাটা বলেন।’
গুলিস্তানের কাছে সেদিন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সবার সামনে ছিলেন নূর হোসেন। এই দৃশ্য তাঁর বড় ভাই দেখে বাড়ি ফিরে বলেছিলেন মায়ের কাছে। এরপর বিকেল থেকে মানুষের মুখে মুখে শোনা যেতে থাকে পুলিশের গুলিতে নূর হোসেনের মৃত্যুর কথা।
শহীদ নূর হোসেনের স্মৃতিকথা যেন শেষ হতে চায় না তাঁর ভাই–বোনের মুখে। ভাই দেলোয়ার হোসেন বললেন নূর হোসেনের সঙ্গে বাসে করে মিরপুর বেড়াতে যাওয়ার গল্প। কথা শেষ না হতেই আরেক ভাই আনোয়ার হোসেন বললেন সেই সময় বোটানিক্যাল গার্ডেনে বসে নূর হোসেনের বই পড়া ও একজন বিদেশি আলোকচিত্রীর ছবি তোলার আরেকটি ঘটনা। কিন্তু এই পরিবারের কাছে এখন নূর হোসেনের ব্যবহার করা কোনো স্মৃতি, ছবি কিছুই অবশিষ্ট নেই।
শহীদ নূর হোসেনের পরিবার জানাল, ‘সব স্মৃতি হারিয়ে গেছে। বিভিন্ন পত্রিকা অফিস থেকে বিভিন্ন সময় নিয়ে গেছে। সবাই ফেরত দেওয়ার কথা বললেও কেউ আর কিচ্ছু ফেরত দেয়নি।’ আমাদের এই সব আলাপের সময় মিরপুর মাজার রোডের তিনতলার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন মরিয়ম বিবি। তাঁর যেন এসব স্মৃতিকথায় আর বিশেষ কিছু আসে যায় না। একটা বড় নিমগাছ আছে এ বাড়ির জানালা লাগোয়া। যদিও এ বাড়িতে নূর হোসেন থাকেননি কিন্তু মায়ের হৃদয়জুড়ে সব সময়ই আছেন সেই সন্তান। যাঁর বয়স আর কোনো দিন বাড়বে না। যিনি আছেন বাংলাদেশে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসের এক অনন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে।
নূর মারা যাওয়ার পর অনেক সরকার নির্বাচিত হইয়া আসছে। দেশ চালাইছে। সেই কবেকার কথা আমার ছেলেটা জীবন্ত পোস্টার হইল, প্রাণ দিল কিন্তু সত্যিকার গণতন্ত্র আর আসল না এই দেশে। আমার ছেলেটা তাইলে কেন প্রাণ দিলনূর হোসেনের মা
সম্প্রতি দেশে আবার একটি বড় গণ-অভ্যুত্থান হলো। স্বৈরাচার সরকারের পদত্যাগের দাবিতে অনেক মানুষ প্রাণ দিল। নূর হোসেনের মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সাধারণ মানুষের মুক্তির যে বাসনা নিয়ে ৩৭ বছর আগে নূর হোসেন আত্মোৎসর্গ করেছিলেন, তা কি পেয়েছেন? মরিয়ম বিবি উত্তর দিলেন, ‘যে কারণে আমার সন্তান প্রাণ দিছে, তা আসে নাই। মানুষ এখনো কথা কইতে ভয় পায়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয় নাই। এইটা কি গণতন্ত্র?’
তাঁর প্রশ্ন, ‘নূর মারা যাওয়ার পর অনেক সরকার নির্বাচিত হইয়া আসছে। দেশ চালাইছে। সেই কবেকার কথা আমার ছেলেটা জীবন্ত পোস্টার হইল, প্রাণ দিল কিন্তু সত্যিকার গণতন্ত্র আর আসল না এই দেশে। আমার ছেলেটা তাইলে কেন প্রাণ দিল?’