মুক্ত ও স্বচ্ছ নির্বাচন কেন জরুরি

নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন শুধু বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশেই ওঠে তা নয়, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।

ইউপি নির্বাচনে ভোট দিতে সকাল থেকে ভোটারদের দীর্ঘ সারি। গত ফেব্রুয়ারিতে খাগড়াছড়ির পানছড়ি বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে

বাংলাদেশ ও পাকিস্তান, দুটি দেশই এখন নির্বাচন প্রশ্নে বহুমুখী জটিলতার সম্মুখীন। এটি কোনো নতুন ব্যাপার নয়, উভয় দেশেই নির্বাচনের ফলাফলের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন অনেক আগে থেকেই উঠছে। দেশের নাগরিক যাঁর যাঁর পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন, অথচ দেখা যাচ্ছে তাঁদের সে নাগরিক ইচ্ছা পুরোপুরি পালিত হচ্ছে না।

বাংলাদেশে ২০১৮ সালের নির্বাচন যথাযথ হয়নি, এ কথা দেশি-বিদেশি ভাষ্যকারেরা নানাভাবে বলেছেন। নির্বাচনের দিন নয়, আগের রাতে ভোটবাক্সে ব্যালট ঢোকানো শেষ, এমন অভিযোগ উঠেছে। মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকেও নির্বাচনে স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে সমালোচনা হয়েছে।

ফরেন পলিসি পত্রিকায় সুমিত গাঙ্গুলি সে নির্বাচনকে ‘গণতন্ত্রের পরিহাস’ আখ্যা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা পত্তনের অভিযোগ তুলেছিলেন। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব্যাপক কারচুপি ও সহিংসতার অভিযোগ তুলে একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচনী অনিয়মের তদন্তের দাবি তুলেছিল।

পাকিস্তানের বিষয়টি অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। সেখানে ভোটে কে জিতবে, কে ক্ষমতায় আসবে, সে রফা নির্বাচনের আগেই চূড়ান্ত করা হয়। ভোট গ্রহণ ও ভোট গণনা শুধু ‘ফর্মালিটি’ মাত্র। ২০১৮ সালে ইমরান খান যে প্রধানমন্ত্রী হলেন, তা কেবল সামরিক কর্তৃপক্ষের নেকনজরের কারণেই। গত সপ্তাহে ওয়াশিংটন পোস্ট–এ এক প্রতিবেদনে পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মীর সে নির্বাচনকে তাঁর দেশের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে নোংরা’ বর্ণনা করে বলেছেন, এই নির্বাচনের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ছিল ব্যাপক ভয়ভীতি, দুর্নীতি ও ঢালাও ভোট চুরি। মীরের দাবি, সামরিক কর্তৃপক্ষের সমর্থন ছিল বলেই ইমরানের পক্ষে ক্ষমতায় আরোহণ সম্ভব হয়।

দুই দেশেই পরবর্তী নির্বাচনের জোর তৎপরতা শুরু হয়েছে। আগামী বছরের শেষ দিকে এই নির্বাচন হওয়ার কথা, তবে দিনক্ষণ এখনো ঘোষণা করা হয়নি। দ্রুত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দাবি জানিয়ে ইমরান খান সারা দেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি এমন কথাও বলেছেন, নির্বাচন স্বচ্ছ ও মুক্ত হলে তিনি জিতবেনই, তবে তাঁকে ঠেকাতে ক্ষমতাসীন মুসলিম লিগ ও সেনাবাহিনীর একাংশ ষড়যন্ত্র করছে। তারা ‘সামরিক আইন’ জারির কথাও ভাবছে, যদিও এ কথার কোনো অর্থপূর্ণ প্রমাণ তিনি দিতে পারেননি। তিনি বলেছেন, ‘আমি সামরিক আইনে ভয় পাই না।’ তবে মুখে যত তুবড়ি ছোটান না কেন, তাঁকে যদি আবার ক্ষমতায় ফিরতে হয়, তাহলে খাকি ইউনিফর্মের সমর্থন নিয়েই আসতে হবে, এ কথায় কোনো ভুল নেই।

বাংলাদেশেও কেউ কেউ তথাকথিত ‘তৃতীয় শক্তি’র উত্থানের ইঙ্গিত করেছেন। কোনো প্রমাণ ছাড়াই এমন দাবি উঠেছে, যদিও তা বাংলাদেশে হরহামেশাই ওঠে। আসল উদ্বেগ নির্বাচনের ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। যে প্রাতিষ্ঠানিক স্থিরতা নির্বাচনকে নাগরিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে, বাংলাদেশে তার অভাব রয়েছে। অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশ ক্রমেই একদলীয় ও একক নেতৃত্বের দেশ হয়ে উঠছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েব পত্রিকা ‘পলিটিকো’ কোনো রাখঢাক ছাড়াই প্রশ্ন তুলেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন? এ বছরের সেপ্টেম্বরে শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে এসেছিলেন। সে সময় তাঁকে সে প্রশ্ন করা হলে তিনি স্পষ্ট জানান, অবশ্যই তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। সারা জীবন তিনি গণতন্ত্রের জন্য লড়ছেন। যদি নির্বাচনে পরাজিত হন, তাহলে বিনা প্রশ্নে তিনি ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াবেন।

নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন শুধু যে বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশেই ওঠে, তা নয়। এই যুক্তরাষ্ট্রের কথা ধরুন। দুই বছর আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো গাঁইগুঁই করে চলেছেন। তাঁর অভিযোগ, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে।

কম্পিউটারের কারসাজিতে তাঁর নামে দেওয়া ভোট জো বাইডেনের নামে চলে গেছে অথবা ইলেকট্রনিক ভোটের কারণে ইতালিতে বসে স্যাটেলাইটের মারফত ভোটের অঙ্ক বদলে ফেলা হয়েছে, এমন তেলেসমাতি অভিযোগও তাঁর সমর্থকেরা করেছেন। বস্তুত যুক্তরাষ্ট্রে এখন নির্বাচনী স্বচ্ছতায় বিশ্বাস করে না, এমন মানুষ দেশের অর্ধেকের বেশি। এদের সবাই যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক, তা–ও নয়।

গণতন্ত্র = গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান

গণতন্ত্রের কথা আমরা যখন বলি, অনেক সময় মুক্ত নির্বাচনের কথাই বুঝিয়ে থাকি। দেশের প্রত্যেক নাগরিক তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিজের পছন্দের ব্যক্তি বা সরকারকে নির্বাচিত করবেন। ক্ষমতাসীন মহলকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করার এটাই শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি—এ কথা সবাই মানেন। কিন্তু এ কথাও ঠিক, শুধু নির্বাচন দিয়ে কোনো দেশ কতটা গণতান্ত্রিক, তা বোঝা অসম্ভব।

আমরা এমন অসংখ্য উদাহরণ জানি, যেখানে নির্বাচনী আইন মেনে ভোট গৃহীত হলেও ক্ষমতায় যারা আসছে, তারা শুধু কর্তৃত্ববাদী, তা–ই নয়, ভয়ানক রকম নাগরিক অধিকারবিরোধী। আজকের হাঙ্গেরি বা পোল্যান্ডের কথা ভাবুন। অথবা ইরান বা উজবেকিস্তান। মতপ্রকাশের সব দরজা সেঁটে দিয়ে এসব দেশে নির্বাচন হয়, যার লক্ষ্য ইতিমধ্যে স্থিরীকৃত ফলাফল ভোটের মাধ্যমে প্রত্যয়ন করা। এসব তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশকে ‘ইললিব্যারেল ডেমোক্রেসি’ নামে অভিহিত করা হচ্ছে। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান খোলামেলাভাবেই বলেছেন, ‘হ্যাঁ, আমার সরকার অনুদার।’ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বলা হয়েছে, সে দেশের নির্বাচন ‘ফ্রি’ হতে পারে, কিন্তু ‘ফেয়ার’ নয়। দেশের ক্ষমতাসীন সরকার যখন সব গণতান্ত্রিক হাতিয়ার নিজের তালুর নিচে রেখে শুধু লোক দেখানো নির্বাচন করে নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করে, সেটা পরিহাস ছাড়া আর কিছু নয়।

একই কথা পোল্যান্ড নিয়ে। সেখানে নির্বাচনে ভোটের বাক্সের বদল হয় না ঠিকই, কিন্তু দেশের বিচারব্যবস্থা পুরোপুরি ক্ষমতাসীন মহলের দখলে। এই অবস্থায় নির্বাচন মুক্ত হবে কী করে!

মোদ্দাকথা, নির্বাচন স্বচ্ছ ও মুক্ত হতে হলে সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকেও গণতান্ত্রিক হতে হবে। এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে নির্বাচন কমিশন, আইন ও বিচার প্রশাসন ও তথ্যব্যবস্থা। নির্বাচনে অর্থের ব্যবহারকেও এই তালিকাভুক্ত করা যায়, যদিও তা নিয়মতান্ত্রিক কোনো প্রতিষ্ঠান নয়।

নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানসমূহ কেন গুরুত্বপূর্ণ, তার একটি আগ্রহোদ্দীপক উদাহরণ আজকের যুক্তরাষ্ট্র। ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানের পর থেকে এ দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার সব হিসাব-নিকাশ একদম ওলটপালট হয়ে গেছে। ২০২০ সালের নির্বাচনের সময় ভোট গণনা শেষ হওয়ার আগেই তিনি নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করে অবশিষ্ট ভোট যেন না গোনা হয়, তার দাবি তোলেন। তাঁর সে কথা অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা কানে তুললেন না। তাতে দমে না গিয়ে তিনি বিভিন্ন রাজ্যের কর্মকর্তাদের ফোন করে দাবি তুললেন, যে পরিমাণ ভোটে তিনি পিছিয়ে আছেন, তা যেন খুঁজে বের করা হয়। অর্থাৎ জাল ভোট তাঁর নামে গুঁজে দেওয়া হয়। জর্জিয়ার ক্ষেত্রে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে মোট ১১ হাজার ৮৭০ ভোটের দাবি তুললেন, যা তাঁর প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে একটি বেশি। তাতেও কাজ না হলে তিনি মামলা ঠুকে দিলেন, প্রথম অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে, সবশেষে সুপ্রিম কোর্টে। সব জায়গায় তিনি গো-হারা হারলেন।

এই উদাহরণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা গ্রুপ যদি গণতান্ত্রিক নীতিমালা লঙ্ঘন করে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ অটুট থাকলে তাতে বাধা দেওয়া সম্ভব। কাজটা কঠিন, কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যাদের আমরা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বলছি, তারা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। কর্তাকে নাখোশ করে পেয়াদা দায়িত্ব পালন করবে—এ কথা ভাবা কঠিন। কিন্তু এ যে অসম্ভব নয়, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যে মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়ে গেল, তাতে যাঁরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ভোট চুরির অভিযোগ তুলেছিলেন, তাঁরা প্রায় সবাই পরাস্ত হয়েছেন। এই পরাজয়কে গণতন্ত্রের বিজয় হিসেবেই দেখা হয়েছে।

নির্বাচন ও নাগরিক আস্থা

নাগরিকদের আস্থা ছাড়া কোনো দেশের সরকারের পক্ষেই কার্যকরভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব হয় না। আজ অথবা কাল তেমন সরকারের ব্যাপারে আপত্তি উঠবেই, নাগরিক অসন্তোষ জন্ম নেবেই।

কয়েক বছর আগে জেনেভাভিত্তিক কফি আনান ফাউন্ডেশনের প্রস্তুত এক গবেষণাপত্রে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, সময়মতো ভোট গ্রহণই নির্বাচনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। এর আসল লক্ষ্য, রাষ্ট্র পরিচালনায় নাগরিকদের কণ্ঠস্বর ও তাঁদের রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রতিফলন প্রতিষ্ঠা। দেশটা তাঁদের, সরকারও তাঁদের। নির্বাচন শুধু তাঁদের সে মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি প্রক্রিয়া মাত্র। আজকের দিনে যেকোনো সরকারের কাছে নিজের বৈধতার পক্ষে একটিমাত্র হাতিয়ার রয়েছে, আর তা হলো বৈধ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক নির্বাচন। নির্বাচনী ব্যবস্থাই যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তাহলে সে সরকারের বৈধতাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

ঠিক কী ব্যবস্থা নেওয়া হলে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা সুরক্ষা সম্ভব, তার কোনো বৈজ্ঞানিক মাপকাঠি নেই। কফি আনান কমিশন একটি ইচ্ছাপত্র প্রকাশ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর জন্য একটা কাঠামো প্রস্তাব করেছে সিভিল লিবার্টিজ ফর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নামের একটি নজরদারি সংস্থা। দেশ ভেদে এই কাঠামোয় বদল হতে পারে, তবে নতুন-পুরোনো সব ধরনের গণতান্ত্রিক দেশের জন্য তা চলতি রোগের কার্যকর ব্যবস্থাপত্র প্রমাণিত হতে পারে।

•  নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি। শুধু ভোট গ্রহণের অধিকারের স্বীকৃতিই যথেষ্ট নয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সে স্বাধীনতায় প্রতিবন্ধক হয় এমন পরিস্থিতি পরিহার করতে হবে।

• ভোটার তালিকাভুক্তি। সব নাগরিক যাতে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়, তা নিশ্চিত করা। ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষা বা আয় ইত্যাদি বৈষম্যমূলক কারণে কেউ যেন এই তালিকায় বাদ না থাকে।

• নির্বাচনী তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা। কে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন, কী তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থান, এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য প্রদান নিশ্চিত করা। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন মহল নানা ছলছুতোয় বিরোধী রাজনীতিকদের তথ্য প্রকাশ ও প্রচারণায় বাধা দেয়। সেটি বন্ধ করতে হবে।

•  নির্বাচনে অংশগ্রহণ। শুধু ভোট দেওয়া নয়, যোগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিক যাতে নির্বাচিত হওয়ার অধিকার রাখেন, তা নিশ্চিত করতে হবে।

•  ভোট প্রদানের সুবিধা। শুধু ভোটাধিকার দিলেই হবে না, যাতে প্রত্যেক ভোটার সহজে ভোট দিতে পারেন, তা–ও নিশ্চিত করতে হবে। ভোট প্রদান কেন্দ্রসমূহ ভোটারের বসবাস বা কর্মের নিকটবর্তী হতে হবে। দুর্গম স্থলে ভোটকেন্দ্র স্থাপনে বিবেচনা রাখতে হবে।

•  নির্ভয়ে ভোট দেওয়া। অনেক ক্ষেত্রে কোনো গোত্র বা শ্রেণিভুক্ত ভোটাররা যাতে ভোটকেন্দ্রে না আসেন, তার জন্য নানা রকম হুমকি ও ভয় দেখানো হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুরা এই প্রচারণার শিকার। সবাই যাতে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন, তার ব্যবস্থা করতে হবে।

•  ভোটের সত্যতা। প্রতিটি আইনসম্মত ভোট গুনতে হবে, মিথ্যা ভোট বাতিল করতে হবে। এই গণনা সম্পূর্ণ স্বচ্ছভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

• প্রতিটি ভোট গণনা। অনেক সময় নির্বাচনী প্রশাসনের কারসাজিতে আইনসম্মত ভোট বাতিল করা হয়। এই প্রবণতা বাদ দিতে হবে।

•  দ্রুত ভোটের ফলাফল ঘোষণা। ফলাফল বিলম্বে ঘোষিত হলে তার বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

এই কাঠামো হয়তো নির্বাচন পরিচালনার একটি সঠিক পথ বাতলে দিল, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত কোনো দেশে নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক, পরাজিত দল বা ব্যক্তি তার ব্যাপারে যে প্রশ্ন তুলবে না, তার গ্যারান্টি নেই। বস্তুত, যে দেশে এই বিভক্তি যত তীব্র যেমন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ৫০-৫০ দেশে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেবে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

কফি আনান কমিশনের মতে, এ ক্ষেত্রে যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় সব দল ও ব্যক্তির অংশগ্রহণের জন্য অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি। অনেকে একে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বলে থাকেন। নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন মহল বিরোধী পক্ষের অংশগ্রহণে যত বাধা সৃষ্টি করবে, নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে অসন্তোষ তত তীব্র হবে।

তবে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ একমত, সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, এমন একটি নির্বাচনী কমিশন গঠন, যার স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নে অধিকাংশ মানুষ ও রাজনৈতিক দলসমূহের আস্থা রয়েছে। নির্বাচনী আইনই যথেষ্ট নয়, তার নিশ্চয়তা বিধান সম্ভব না হলে সে আইন শুধু কাগুজে কথা মাত্র।

আর তা সম্ভব করতে হলে একদিকে চাই তথ্যমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা; অন্যদিকে প্রচলিত আইন যথাযথ পালিত হচ্ছে কি না, তার নজরদারির জন্য সুশীল সমাজভুক্ত সংগঠনসমূহের পূর্ণ অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা। চোর ধরতে পুলিশ থাকতেই হবে, কিন্তু সেই পুলিশের কাজও যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, তার জন্যই এই ব্যবস্থা জরুরি।