সৈকতে ভেসে আসা কাঠ দিয়ে শিল্পকর্ম তৈরিতে ব্যস্ত আখতার আহমেদ
সৈকতে ভেসে আসা কাঠ দিয়ে শিল্পকর্ম তৈরিতে ব্যস্ত আখতার আহমেদ

যুক্তরাষ্ট্রের সৈকতে ভেসে আসা ডাল-কাঠে ফুটিয়ে তুলছেন বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির বাসা থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের পাড় খুব বেশি দূরে নয়, মাত্র আধা ঘণ্টার পথ। তাই সাগরের সৌন্দর্য আর বিশালতা উপভোগ করতে আখতার আহমেদ (রাশা) প্রায়ই চলে যান সাগরপাড়ে। ঢেউয়ের সঙ্গে সৈকতে ভেসে আসা নানা গাছের ডাল ও কাঠ কুড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে আসেন। পরিত্যক্ত এসব জিনিস দিয়ে গড়ে তোলেন নানা শিল্পকর্ম। তাঁর নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় ডাল বা কাঠের টুকরায় ফুটে ওঠে ইতিহাস-ঐতিহ্য বা বিখ্যাত কারও মুখের অবয়ব।

নীলফামারীর আখতার আহমেদ ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। শৈশবে হস্তশিল্প তৈরির ক্লাসে খুব ভালো করতেন। তখন অনেক শিক্ষক তাঁকে চারুকলায় পড়ারও পরামর্শ দিতেন। তবে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের তখন চারুকলায় পড়া অনেকটাই শৌখিনতার বিষয় ছিল। তাই আর পড়া হয়নি। পড়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে। তবে শৈশবের শিল্পকর্মের প্রতি সেই ভালোবাসা ছাড়তে পারেননি। তবে এ কাজ এখন তাঁর খানিকটা পেশায় পরিণত হয়েছে। শিল্পকর্ম বিক্রি করে আয়ও করছেন।

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত আখতার আহমেদের হাতে শিল্পরূপ পেয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস–ঐতিহ্যের নানা স্মারক

২০০২ সাল থেকে কুড়িয়ে পাওয়া ডাল-কাঠ দিয়ে বানিয়েছেন পাঁচ শতাধিক শিল্পকর্ম। এগুলোতে ভাষা আন্দোলন, বধ্যভূমি, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের গ্রাম, নির্যাতনের শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা সংকট, করোনা মহামারি, মা ও সন্তান, শীতের ভোরে খেজুরের রস, কার্টুন চরিত্র টোকাই, প্রেম-ভালোবাসাসহ বিভিন্ন শিরোনামের শিল্পকর্মে বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য উঠে এসেছে। তারকাঁটা দিয়ে শিল্পকর্ম বানানোর পাশাপাশি ওয়াল আর্টও তৈরি করছেন তিনি।

আখতার আহমেদের সঙ্গে ৫ জানুয়ারি প্রথম আলো কার্যালয়ে কথা হয় প্রথম আলোর। চারুকলায় না পড়েও কীভাবে শিল্পকর্মে জড়ালেন, এমন প্রশ্নে আখতার আহমেদ হাসতে হাসতে বলেন, ‘কোনো জায়গায় গেলে সবার আগে গাছের ডাল, কাঠের গুঁড়িতে চোখ যায়। বান্দরবানে সাঙ্গু নদে বেড়াতে গিয়েও গাছের ডাল কুড়িয়ে এনে আত্মীয়ের বাসায় রেখেছি। জানি, যুক্তরাষ্ট্রে এগুলো নিতে পারব না। আমার শিল্পকর্ম নিয়ে ভবিষ্যতে দেশে একটি প্রদর্শনী করার ইচ্ছা আছে। তখন হয়তো এ কাঠ থেকেও কোনো কিছু বানাতে পারি।’

সৈকতে ভেসে আসা কাঠের গুঁড়ি সংগ্রহ করছেন আখতার আহমেদ

আখতার আহমেদ বলেন, সমুদ্রসৈকতে ভেসে আসা এসব কাঠকে ‘ড্রিফট উড’ বলা হয়। এই ড্রিফট উড টেকসই ও সুন্দর। এগুলো শিল্পকর্মের জন্য বেশ কাজের। তবে সংগ্রহ করা বেশ কঠিন। সংগ্রহ করার পর তাৎক্ষণিক তা থেকে কোনো শিল্পকর্মের কথা মাথায় না–ও আসতে পারে। এগুলো পরিষ্কার করা, হাতুড়ি-বাটাল দিয়ে একটা আকৃতিতে আনা—সব মিলিয়ে কঠিন পরিশ্রম ও ধৈর্যের কাজ। স্ত্রী ও দুই ছেলের সহযোগিতা না পেলে দীর্ঘদিন ধরে এ কাজ করা সম্ভব নয়।

দেশে ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর শিল্পকর্মের একটি প্রদর্শনী দেখেছিলেন আখতার। ফেলনা জিনিস দিয়ে এত সুন্দর শিল্পকর্ম হতে পারে, তা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। নিউজার্সিতে ফিরে নিজে কিছু করতে পারেন কি না, তা নিয়ে চেষ্টা করতে থাকেন। ফেলনা কাঠ দিয়ে নৌকা, খেয়াঘাট বানিয়েছিলেন। এক বিদেশি প্রতিবেশী বাড়িতে এসে সেগুলো নিয়ে যান। বিনিময়ে ১৬০ ডলারও দিয়েছিলেন। সেই থেকে শুরু।

একাত্তরে মুক্তিকামী বাঙালির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাডিসন স্কয়ারে কনসার্ট আয়োজনের কারিগরদের শিল্পকর্মে মূর্ত করে তুলেছেন আখতার আহমেদ

নিউজার্সির বাড়ির নিচতলাকে আখতার প্রদর্শনী কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছেন। সেখানে বসেই চলে কাজ। পুরো বাড়িতেই সাজিয়ে রাখা হয়েছে নানা শিল্পকর্ম। সেখান থেকেই শিল্পকর্ম বিক্রি হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রদর্শনীতেও শিল্পকর্ম বিক্রি হয়। বাঙালি বন্ধু, স্বজনদের পাশাপাশি বিদেশিরাও কেনেন।

২০১৫ সালে নিউজার্সিতে ‘অনুভূতির মুহূর্ত’, ২০১৭ সালে ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’, ২০২০ সালে ‘শিল্পে শিকড়’ শীর্ষক একক প্রদর্শনীর আয়োজন করেন আখতার। ২০১৯ সালে ‘প্রতিরোধ ও বিজয়’ শিরোনামে দলীয় প্রদর্শনীতে অংশ নেন। ২০২১ সালে ‘অগ্রজ সান্নিধ্যে শিল্প সন্ধ্যা’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে কাঠের মধ্যে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মুখাবয়ব করা ভাস্কর্য তাঁদের হাতে তুলে দেন আখতার আহমেদ।

শিল্পকর্মে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের অবয়ব ফুটিয়ে তুলেছেন আখতার আহমেদ

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এই বাংলাদেশি শিল্পী বলেন, নিউজার্সির অন্য শিল্পীরা তাঁর কাজের প্রশংসা করেন। তবে শিল্পে যেহেতু তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেন, তাই শিল্পীদের ফোরামগুলোতে তিনি ডাক পান না।

আখতার আহমেদ এ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তির ভাস্কর্য তৈরি করেছেন। কাঠের গুঁড়া, সিমেন্ট এবং গ্লু দিয়ে চোখ, নাক ও ঠোঁট তৈরি করেন। পারতপক্ষে বাড়তি কোনো রং ব্যবহার করেন না। লালন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, জয়নুল আবেদিন, শাহ আবদুল করিম, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, আসাদ চৌধুরী, সেলিম আল দীন, আজম খান, মির্জা গালিব, ওয়াল্ট হুইটম্যান, এমিলি ডিকেনসন, রবার্ট ফ্রস্ট, পাবলো নেরুদা, রবি শংকর, সত্যজিৎ রায়, সোফিয়া লরেন, জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলানের মতো ব্যক্তিত্বের মুখাবয়ব ফুটিয়ে তুলেছে ফেলনা কাঠে। তাঁর এ ধরনের কাজ দিন দিন বাড়ছে।

মেয়ের যখন মাত্র দুই বছর, তখন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান আখতার আহমেদ। মেয়ের মস্তিষ্কে একধরনের (ভাইরাল এনসেফালাইটিস) সংক্রমণ দেখা দেয়। মশার কামড় বা মেয়াদোত্তীর্ণ টিকায় এমনটা হতে পারে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন। সন্তানের উন্নত চিকিৎসার জন্যই বিদেশে যাওয়া। তবে মেয়ের অবস্থার উন্নতি হয়নি, তাঁদেরও আর দেশে ফেরা হয়নি। মেয়ের চিকিৎসার সূত্রেই প্রতিবন্ধী ও প্রবীণ ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানে আখতার আহমেদ কাজ করছেন।

বাংলাদেশে তুমুল জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র ‘টোকাই’কেও শিল্পকর্মে তুলে ধরেছেন আখতার আহমেদ

আখতার আহমেদ বলেন, তিনি প্রতিষ্ঠিত কোনো শিল্পী বা ভাস্কর নন। তবে তাঁর কোনো কাজ যখন কেউ পছন্দ করেন, তখন কাজের প্রতি তাঁর ভালো লাগাটা আরও বেড়ে যায়। এক প্রদর্শনীতে মুক্তিযুদ্ধের সময় গরুর গাড়িতে করে শরণার্থীরা যাচ্ছে, এমন একটি শিল্পকর্ম দেখে অনুবাদক আনিসুজ্জামান আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন। এ শিল্পকর্মের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা মিলে গিয়েছিল। শিল্পকর্মটির নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি অর্থ দিয়ে তিনি কিনে নিয়েছিলেন। ‘অনুভূতির মুহূর্ত’ শিরোনামে প্রথম একক প্রদর্শনীর ৬৬টি শিল্পকর্মের ৩৩টি শিল্পকর্মই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।

আখতার আহমেদ আরও বলেন, তাঁর দুই ছেলের জন্মই নিউজার্সিতে। স্ত্রী মেরিস্টেলা আহমেদ ছায়ানট থেকে গান শিখেছিলেন, এখনো গানের চর্চা করেন। দেশের জনপ্রিয় সিনেমার পোস্টার, কনসার্ট ফর বাংলাদেশসহ বিভিন্ন পোস্টার সংগ্রহে রাখাও তাঁর নেশা। সব মিলে নিউজার্সির বাড়িটিকে একটুকরা বাংলাদেশও বলা যায়।