নতুন একটি মথের (গণ ও প্রজাতি) নামকরণকারীদের তালিকায় সম্প্রতি নাম লিখিয়েছেন বাংলাদেশি এক দম্পতি। তাঁরা হলেন মো. জহির রায়হান ও সায়েমা জাহান।
ছয় মাসের গবেষণার পর এই দম্পতি নতুন মথটির (গণ ও প্রজাতি) নামকরণ করেন। নাম—‘প্যারাক্সিনোয়াক্রিয়া স্পিনোসা’ (Paraxenoacria spinosa)।
জহির-সায়েমা কাজটি শুরু করেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহপাঠী-বন্ধু হিসেবে। এক মাস হলো তাঁদের বিয়ে হয়েছে। সায়েমা বললেন, বিশ্বের যে কেউ যখন এই মথটি নিয়ে গবেষণা করবেন, তখন এর নামের পাশে ‘রায়হান অ্যান্ড জাহান’ লেখা দেখবেন।
গত রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে এই মথটির নামকরণ নিয়ে কথা বলেন তরুণ বিজ্ঞানী সায়েমা। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামের সঙ্গে মিলিয়ে একটি মথের নামকরণ হওয়ার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ট্রাম্প। ২০১৭ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তাঁর নামের সঙ্গে মিলিয়ে একটি মথের নামকরণ করা হয়—‘নিওপালপা ডোনাল্ডট্রাম্পি’। মথটি আবিষ্কার করেছিলেন কানাডার এক গবেষক। মথটির মাথায় সোনালি রঙের আঁশ আছে। এই আঁশ দেখতে অনেকটা ট্রাম্পের মাথার চুলের মতো। মূলত এই মিল থেকেই মথটির নামকরণ করা হয়। এ নিয়ে তখন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হয়েছিল।
সায়েমা বললেন, ‘আমাদের ল্যাব সমস্যা ছিল। বয়সও কম। অনেক ‘না’-এর মধ্যে কাজটি করতে হয়েছে। তাই আমাদের দেওয়া নামটিই যখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তখন খুবই ভালো লেগেছে। মনে হয়েছে, অনেক ‘না’-এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ শুনতে পেলাম আমরা।’
সায়েমার বাড়ি চাঁদপুর। আর জহির বাড়ি পিরোজপুর। ২০২৩ সালে দুজন স্নাতক করেন। বিয়ের পর জহির যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে এক বছরের গবেষণা কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন।
সায়েমা বর্তমানে সুন্দরবনের বিলুপ্তপ্রায় বিশেষ এক প্রজাপতি নিয়ে কাজ করছেন। থাকছেন রাজধানীর মিরপুরে বড় বোনের বাসায়।
হাসতে হাসতে সায়েমা বললেন, স্বামী-স্ত্রী এখন পৃথিবীর দুই প্রান্তে থাকলেও তাঁদের কথোপকথনে ঘরসংসারের আলাপ তেমন গুরুত্ব পায় না। বরং আলাপ চলতে থাকে প্রজাপতি প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি বা মথ নিয়ে।
জহিরের সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। জহির-সায়েমা দম্পতি জানালেন, প্রজাপতি ও মথ একই দলভুক্ত আলাদা দুই ধরনের পতঙ্গ। সাধারণত প্রজাপতির দেখা মেলে দিনে। আর মথের দেখা মেলে রাতে। উভয়ের জীবন—ডিম-শুঁয়োপোকা-পিউপা (মূককীট) তারপর পূর্ণবয়স্ক দশা—এভাবে বিস্তার ঘটে। প্রজাপতি দেখতে বেশি উজ্জ্বল।
মথের নামকরণ প্রসঙ্গে সায়েমা বললেন, মানুষ সন্তানের নাম রাখার সময় যেমন কোন নামটি সুন্দর, কোন নামটির অর্থ ভালো, অন্যদের সঙ্গে মিলে যাবে না—এসব চিন্তা করে, তেমনি মথের নামকরণেও অনেক কিছু চিন্তা করতে হয়। অনেকে প্রিয় মানুষের নামে নামকরণ করেন। এই মথটির বেলায় জহির তাঁর (সায়েমা) নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু তাঁর (সায়েমা) মনে হয়েছে, এতে এই মথের যে বৈশিষ্ট্য, তা হারিয়ে যাবে।
সায়েমা জানালেন, নামকরণ চূড়ান্ত হওয়ার আগে বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে নিবন্ধ লিখে জমা দেওয়া, রিভিউ হওয়া, আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ হওয়া, জু ব্যাংক থেকে নিবন্ধন করাসহ অনেকগুলো ধাপ পার হতে হয়।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে জহির-সায়েমা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশ থেকে লার্ভা ও পূর্ণবয়স্ক মথ সংগ্রহ করেন। নিজেদের ছোট ল্যাবে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে তা যাচাইবাছাই করেন। ‘প্যালিওপোডিডি’ পরিবারের অন্যান্য জেনাসগুলোর সঙ্গে তুলনা করে তাঁরা নিশ্চিত হন, এই মথটি অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা।
জহির-সায়েমা দম্পতি মথটির বৈজ্ঞানিক নামকরণের জন্য তাঁদের নিবন্ধ নিউজিল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ‘জুট্যাক্সা’ সাময়কীতে পাঠান। সেখানে দুজন বিজ্ঞানী তাঁদের নিবন্ধটি পর্যালোচনা করেন। জহির-সায়েমার তুলনা ও ব্যাখ্যা তাঁরা মঞ্জুর করেন।
চলতি অক্টোবর মাসে ‘অ্যা নিউজ জেনাস অ্যান্ড স্পেসিস অব পেলিওপোডিডি হজেস, ১৯৭৪ (ইনসেকটা: লেপিডোপটেরা) ফ্রম সাউথ-এশিয়া’ শিরোনামের নিবন্ধটি সাময়িকীটিতে প্রকাশিত হয়।
‘আইন্যাচারালিস্ট’ নামে ওয়েবসাইটে ব্যবহারকারীরা মথ, পাখি, প্রজাপতিসহ অন্যান্য পোকামাকড়ের ছবি শেয়ার করেন। গবেষকেরা এই ছবিগুলোর মাধ্যমে প্রজাতিগুলোর অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পান।
সায়েমা বললেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে তাঁরা মথের ‘প্রেমে’ পড়েন। মথের নামকরণ দিয়ে কাজের শুরু হলেও তাঁরা যেতে চান বহুদূর। বাংলাদেশে সাপ, প্রজাপতিসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে অনেকে কাজ করলেও মথ নিয়ে কাজ হয়েছে খুব কম।
জহির জানান, সুন্দরবনের পাশেই বাড়ি হওয়ায় প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। প্রকৃতির সবকিছু নিয়ে তাঁর কৌতূহল ছোট থেকেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর জানার পরিধি বাড়তে থাকে। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের শৌচাগারে মথের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় ও ছবি তোলা শুরু। এগুলোর নাম খুঁজে বের করা শখ ও নেশার মতো হয়ে যায়। ২০১৮ সাল থেকে মথ নিয়ে পড়াশোনার শুরু করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু গ্রুপের সঙ্গে যোগ হয়ে এ নিয়ে চর্চা বাড়তে থাকে।
জহির বলেন, গত বছর তিনি প্রথম মথের একটি নতুন প্রজাতির সন্ধান পান। নামকরণ করেন ‘Phragmataecia ishuqii’। চলতি বছরের জুলাইয়ে আরেকটা মথের নাম দেন ‘Schistophleps kendricki’। আর সবশেষ তিনি ও সায়েমা মিলে ‘paraxenoacria spinosa’ নামে নতুন মথের (গণ ও প্রজাতি) নামকরণ করেন।
জহির রায়হান বলেন, সবশেষ এই মথটি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। তবে কারও কাছ থেকেই তেমন সহযোগিতা পাননি। পরে তিনি ও সায়েমা বিশ্লেষণ করে নিবন্ধ লিখে তা জার্নালে পাঠিয়ে দেন। এই প্রথম কোনো বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধান ছাড়া তাঁরা কাজটি করলেন। বাংলাদেশ থেকে মথের একটি নতুন জেনাস ও নতুন প্রজাতির সন্ধান পেলেন তাঁরা।
এ কাজের জন্য জহির ও সায়েমা পরস্পরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। জহির বললেন, তাঁদের সেভাবে ল্যাব ও বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম ছিল না। দুজনে দুটো মাইক্রোস্কোপসহ অন্যান্য সরঞ্জাম কিনে নিজেদের ঘরেই গবেষণার কাজ শুরু করেছিলেন। ঘরেই মথ সংরক্ষণ করতেন তাঁরা।
জহির ও সায়েমা বললেন, নামকরণের পর মথের নমুনাটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে সংরক্ষণ করার জন্য জমা দিয়েছেন, যাতে অন্যরা এটি নিয়ে গবেষণা করতে পারেন।
জহির বললেন, ‘মথের ডানায় চড়েই আমি ও আমার স্ত্রী বিশ্ব জয় করতে চাই। বাংলাদেশ থেকে আরও অনেক নতুন গণ–প্রজাতির মথ আবিষ্কার করতে চাই।’