রাজধানীর একটি বিপণিবিতানে স্যামসাংয়ের শোরুমে তাদের এ-৫৪ মডেলের মুঠোফোনের দাম লেখা ৫৯ হাজার ৯৯৯ টাকা। একই ব্র্যান্ডের ওই মডেলের ফোনের খোঁজ করা হয় একই বিপণিবিতানের আরেক দোকানে, যারা নানা ব্র্যান্ডের ‘আন-অফিশিয়াল’ ফোন বিক্রি করে। সেখানে দাম চাওয়া হলো ৩৮ হাজার টাকা।
দামের পার্থক্যের কারণ হিসেবে দোকানিরা বলছেন, তাঁরা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা শুল্ক দেন না। তাই ফোনের দাম কম। ফলে তাঁদের বিক্রি কমেনি।
বিপরীতে দেশে মুঠোফোন উৎপাদনকারীরা বলছেন, তাঁদের মুঠোফোনের উৎপাদন ও বাজার কমেছে। মোট বাজারের ৪০ শতাংশই অবৈধ মুঠোফোনের দখলে গেছে। দাম কম হওয়ায় ক্রেতা ‘আন-অফিশিয়াল’ ফোনের দিকে ঝুঁকছেন। আন-অফিশিয়াল ফোনের একটি বড় অংশ হলো, অবৈধভাবে দেশে আনা মুঠোফোন।
দেশে মুঠোফোনের যে চাহিদা, তার ৯০ শতাংশ মেটানোর সক্ষমতা আছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর। কিন্তু ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ এলসি খোলার জটিলতায় কাঁচামাল আমদানি কমেছে। পাশাপাশি অবৈধ মুঠোফোনের বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। অবৈধ মুঠোফোনের বাজার দেশীয় উৎপাদনকারীদের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।রিজওয়ানুল হক, সিইও, ট্রানশান বাংলাদেশ লিমিটেড
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকার ২০১৭ সালে দেশে মুঠোফোন উৎপাদনের নীতিগত অনুমোদন দেয়। দেশে এখন ১৪টির মতো প্রতিষ্ঠান মুঠোফোন উৎপাদন করছে। স্যামসাং, অপো, বিভো, টেকনো, সিম্ফনি, ওয়ালটন, লাভা, শাওমি, নোকিয়া, রিয়েলমির মুঠোফোন দেশে উৎপাদন করা হয়।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশে এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম মুঠোফোন উৎপাদিত হয়েছে গত এপ্রিলে। ওই মাসে ১৪ লাখ ৭৮ হাজার উৎপাদিত হয়। গত বছর এপ্রিলে উৎপাদন ছিল ৩৩ লাখ ৮১ হাজার।
মুঠোফোন উৎপাদনকারীরা বলছেন, দেশে বছরে স্মার্টফোনের চাহিদা এক কোটির মতো এবং ফিচার ফোনের চাহিদা আড়াই কোটির মতো। দেশের মোট বাজারের ৪০ শতাংশই অবৈধ মুঠোফোনের দখলে। এ বাজার প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার।
মোবাইল ফোন ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে মুঠোফোন উৎপাদনের জন্য প্রায় ৪০ ধরনের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এসব আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় ৮ শতাংশ। উৎপাদন পর্যায়ে ৫ শতাংশ মূসক দিতে হতো। এবারের বাজেটে তা বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় অগ্রিম আয়কর (এআইটি) ২ শতাংশ; অর্থাৎ একটি ফোন উৎপাদনে ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ শুল্ক ও মূসক দিতে হয়। উৎপাদিত ফোন গ্রাহকের হাতে পৌঁছাতে তিন পর্যায়ে যুক্ত হয় ১৫ শতাংশ মূসক। সব মিলিয়ে ফোনের দাম বেড়ে যায়।
মুঠোফোনের বাজার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অবৈধভাবে যেসব মুঠোফোন বাজারে আসছে, সেখানে কর ও মূসকের কিছুই দিতে হয় না। ফলে তাদের ফোনের দাম কম হয়।
মুঠোফোন উৎপাদনকারীরা বলছেন, দেশে বছরে স্মার্টফোনের চাহিদা এক কোটির মতো এবং ফিচার ফোনের চাহিদা আড়াই কোটির মতো। দেশের মোট বাজারের ৪০ শতাংশই অবৈধ মুঠোফোনের দখলে। এ বাজার প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার।
বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ট্রানশান বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রিজওয়ানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দেশে মুঠোফোনের যে চাহিদা, তার ৯০ শতাংশ মেটানোর সক্ষমতা আছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর। কিন্তু ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ এলসি খোলার জটিলতায় কাঁচামাল আমদানি কমেছে। পাশাপাশি অবৈধ মুঠোফোনের বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। অবৈধ মুঠোফোনের বাজার দেশীয় উৎপাদনকারীদের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০২১ সালের জুলাই মাসে অবৈধ মুঠোফোন বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিল বিটিআরসি। ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি রেজিস্ট্রার (এনইআইআর) নামের এক ব্যবস্থায় অবৈধভাবে আমদানি করা মুঠোফোন চালু করা যাবে না বলে জানানো হয়েছিল। একই বছর ১ অক্টোবর এনআইআর চালুও করা হয়। কিন্তু অক্টোবরের শেষ দিকে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পুনরায় এনইআইআর ব্যবস্থা চালু প্রসঙ্গে বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে ভাবছি না। উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।’
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই ২০২১ সালে চালু করেও এনইআইআর ব্যবস্থা বন্ধ করা হয়েছিল। এ বিষয়ে টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার গতকাল বলেন, অবৈধ মুঠোফোন ঠেকানোর জন্য রাজস্ব বোর্ডকে ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার এখান থেকে রাজস্ব হারাচ্ছে। বিমানবন্দর দিয়ে এসব ফোন বেশি আসে। চোরাচালান বন্ধ হলে মুঠোফোনের বাজারে ভারসাম্য আসবে।