ডেঙ্গু পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে

অতীতে দেখা গেছে, অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসে। কিন্তু এ বছরে তা হয়নি। অক্টোবরে মারা গেছেন ৮৬ জন।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত সাত বছরের শিশু আফিফ আল কাজয়াল। রাজধানীর মিরপুর ১ নম্বরে তাদের বাসা। দুই দিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছে শিশুটি। গতকাল রাজধানীর শিশু হাসপাতালে

এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুসংখ্যা দুই শ ছাড়িয়েছে। এই মৃত্যু আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু রোগী ব্যবস্থাপনায় জোর দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কথা ভাবছে। তারা বলছে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি কিছুটা জটিল হচ্ছে।

গতকাল রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, ডেঙ্গুতে আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে ২০২ জনের মৃত্যু হলো। এর আগে কোনো বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা দুই শ ছাড়ায়নি। ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে বড় আকারে দেখা দেয় ২০১৯ সালে। ওই বছর ডেঙ্গুতে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

অতীতে দেখে গেছে, অক্টোবর–নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসে। কিন্তু এ বছর অক্টোবর মাসে প্রায় ২২ হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছে ৮৬ জন। 

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা ও মেডিসিন সোসাইটি অব বাংলাদেশ যৌথভাবে রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে ডেঙ্গুর চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রায় আড়াই শ চিকিৎসক অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া দেশের সব সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা অনলাইনে এ অনুষ্ঠানে যুক্ত হন। অনুষ্ঠানে বর্তমান পরিস্থিতিতে চিকিৎসদের করণীয় বিষয়ে আলোচনা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ও মেডিসিন সোসাইটি অব বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডেঙ্গু চিকিৎসার নির্দেশনা তৈরি করা হয়েছিল ২০১৮ সালে। অতি সম্প্রতি সেই নির্দেশিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে সেই হালনাগাদ নির্দেশিকা ব্যবহার করে ডেঙ্গু রোগী ব্যবস্থাপনার বিষয়ে চিকিৎসকদের বলা হয়েছে।’

আহমেদুল কবীর আরও বলেন, এ বছর ডেঙ্গু রোগীর অবস্থা হঠাৎ খারাপ হয়ে পড়ছে এমন কথা রোগীর স্বজন ও চিকিৎসকদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে। পরিস্থিতি কিছুটা জটিল। কারণ, একই সঙ্গে ডেঙ্গুর তিনটি ধরন এখন সক্রিয় রয়েছে।

কেন পরিস্থিতি জটিল

চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন: ডেন–১, ডেন–২, ডেন–৩ ও ডেন–৪। একটি ধরনে একবার আক্রান্ত হলে মানুষের শরীরে সেই ধরনটির প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠে, মানুষ দ্বিতীয়বার সেই ধরনে আর আক্রান্ত হয় না। ডেন–১–এ আক্রান্ত ব্যক্তি আর কখনো ডেন–১ দ্বারা আক্রান্ত হবে না। তবে বাকি তিনটি ধরন থেকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

অন্যদিকে কোনো ব্যক্তি প্রথমবার একটি ধরন দিয়ে আক্রান্ত হওয়ার পর দ্বিতীয় বার যদি অন্য ধরন দিয়ে আক্রান্ত হয়, তাহলে ওই ব্যক্তির জটিলতা বাড়ে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডেন–১–এ আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পর ডেন–২ বা ডেন–৩ বা ডেন–৪ দ্বারা আক্রান্ত হলে জটিলতা বাড়ে।

এ বছর যারা ডেঙ্গুতে মারা গেছে, তারা অতীতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল কি না, সেই তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই। তবে অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) একজন কর্মকর্তা বলেছেন, তাঁরা এ তথ্য জানার চেষ্টা করছেন। সিডিসি ইতিমধ্যে সরকারি–বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ১২০ জন রোগীর ফাইল সংগ্রহ করেছে।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিপ্তর মৃত্যুর সঠিক কারণ অনুসন্ধানে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালককে সভাপতি করে সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুজনিত মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটি পুনর্গঠন করেছে।

গতকাল আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরীন প্রথম আলোকে বলেন, কমিটি এ পর্যন্ত দুটি সভা করেছে। মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনার ফলাফল জানতে এ মাস লেগে যেতে পারে।

তাহমিনা শিরীন আরও বলেন, ২০১৬ পর্যন্ত দেশের মানুষ ডেন–১ ও ডেন–২ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে রোগীদের ৯০ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছিলেন ডেন–৩ এর দ্বারা। এ বছর পরিস্থিতি ভিন্ন।

কক্সবাজার এলাকায় এ বছর ডেন–১ দেখা গেছে। আর ঢাকায় দেখা যাচ্ছে ডেন–৩ ও ডেন–৪। তিনি বলেন, ‘এখন ঢাকায় যাঁরা ডেন–৩ বা ডেন–৪–এ আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁরা অতীতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন কি না বা আক্রান্ত হয়ে থাকলে কোন ধরনের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন, তা এখনো আমাদের জানা নেই।’

কোথায় কত মৃত্যু

বিভাগভিত্তিক হিসাবে বরাবরের মতো এ বছরও সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ঢাকা বিভাগে। ঢাকা বিভাগে ১২১ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের কন্ট্রোল রুম। এর মধ্যে ১১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন হাসপাতালে।

ঢাকার পর সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। এ বিভাগে এ পর্যন্ত ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শুধু কক্সবাজার জেলাতেই মারা গেছেন ২৪ জন। এর মধ্যে বড় অংশটি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা।

সিডিসি সম্প্রতি ১৪৮ জন মৃত ব্যক্তির তথ্য পর্যালোচনা করে বলেছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তিন দিনের মধ্যে ৬৪ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পরই অধিকাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।