প্রতিরোধের সংস্কৃতিই জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের
প্রতিরোধের সংস্কৃতিই জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের

নিবন্ধ

রক্তাক্ত স্বাধীনতার মূল্য

স্বাধীনতা শব্দটি একদিকে যেমন উদাত্ত, তেমনি মধুর। বেশ মিষ্টি একটা অনুভব পাওয়া যায়। কিন্তু শব্দটি রক্তে ভেজা একটি শিশুর মতো। বহু কষ্টে মাতৃগর্ভ থেকে একটি শিশুর জন্ম হয়, তেমনি স্বাধীনতার সঙ্গে পুঞ্জ পুঞ্জ রক্তকণাও থাকে।

কিন্তু মানবজাতি আসলেই কি স্বাধীন? যেদিন থেকে পৃথিবীতে সভ্যতা এসেছে, সেদিন থেকেই মানুষ পরাধীন। পরাধীন পরিবারের কাছে, সমাজের কাছে, আর তারপর রাষ্ট্রের কাছে। আবার সেই রাষ্ট্র যদি অন্য রাষ্ট্রের কাছে পরাধীন হয়। সেই পরাধীনতা সততই নিষ্ঠুর। ব্রিটিশ শাসনের পরাধীনতার নিষ্ঠুরতা আমরা দেখিনি, কিন্তু সে ইতিহাস জেনেছি। কী করে মুষ্টিমেয় সৈনিক দিয়ে নবাব সিরাজউদদৌলাকে হত্যা করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দখল করে নিল।

ব্রিটিশরা কালক্রমে সারা ভারতবর্ষকে শুধু পদাবনতই করল না, দুঃশাসনে ও নানা কলাকৌশলে প্রায় দুই শ বছর নিপীড়ন ও লুণ্ঠন করে কিছু অপরিণামদর্শী ও দাঙ্গাবাজের হাতে দিয়ে চলে গেল। হায় স্বাধীনতা, লাখো মানুষের মৃত্যু ও দেশত্যাগ! বাস্তুভিটাচ্যুত হয়ে দুটো পতাকাই শুধু মিলল। একদিকে আওয়াজ উঠল, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’; অন্যদিকে ভাষাকে কেড়ে নেওয়ার বিপরীতে আওয়াজ উঠল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য, রাজনৈতিক ও সামাজিক নিপীড়ন শেষে পূর্ব বাংলা আবার ১০ বছরের মাথায় হয়ে গেল পরাধীন, সামরিক শাসনের অধীন। মিলিটারির বুটের যে কী শক্তি, তা দেখতেই থাকলাম। হায় রে স্বাধীনতা!

অবশেষে এক লড়াই, সে এক অদ্ভুত লড়াই। একদল সশস্ত্র সৈনিক নিজের দেশটাই দখল করে ফেলল। আমরাও অস্ত্র হাতে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালাম। সেই যুদ্ধে ওই দখলদারেরা পরাজিত হলো। আবার রক্তভেজা শব্দটি আমরা ফিরে পেলাম—স্বাধীনতা।

স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই দেশটা চলে গেল আবার বুটের তলায়। সেই পাকিস্তানি শাসকদের একই কায়দায় ক্ষমতা দখল। মানুষের স্বাধীনতার হরণও আবার। আবার লড়াই। এবার গণতান্ত্রিক শাসনের লড়াই। এর মধ্যে আবার ভোটের লড়াই। সে লড়াইয়ে আবার বিভক্ত জাতি। সেই বিভক্ত জাতিকে নিয়েই লড়াই। ক্ষমতার লড়াই। এ লড়াইয়ে জেতার জন্য মরিয়া দুটি পক্ষ। জাতিগতভাবে আমরা সহনশীলতা শিখিনি। শিখিনি পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা। আমরা বলতে থাকি, আমিই সঠিক। বলতে বলতে কখনো ক্লান্ত হই না। বলতেই থাকি।

এ দেশের মানুষ এবং তাদের সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য একদিন বাঙালি স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছিল। সেই সংগ্রাম ছিল রক্তাক্ত। সেই রক্তাক্ত স্বাধীনতার মূল্য কি আমরা দেব না?

অথচ আমরা যারা নাগরিক, তারা একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ি। দুই পক্ষের লড়াইয়ে একসময় ধর্ম ব্যবসায়ীরা এসে হাজির হয়। তারা হয়ে ওঠে সিদ্ধান্তের নিয়ামক। তারা প্রথমেই সঙ্গোপনে হাজির হয় সংস্কৃতিতে, যেমন হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রয়োজনে যখন পাকিস্তান হলো, তখন প্রস্তাব উঠেছিল, উর্দুই যখন রাষ্ট্রভাষা হবে, তখন বাংলা ভাষাটাও উর্দু বা আরবিতে লিখলে অসুবিধা কী?

এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বাংলার পক্ষে রায় দিয়েছিল এবং বাঙালির সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছিল। আমাদের শিল্প-সাহিত্যের নতুন ভিত্তি গড়ে উঠেছিল। মুসলিম পরিবারে বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা গড়ে উঠেছিল। এই চর্চার ফলে একটা প্রতিরোধের সংস্কৃতিও দেখা দিল। সেই প্রতিরোধের সংস্কৃতিই বাংলাদেশের জন্ম পর্যন্ত এগিয়ে গেল।

প্রতিক্রিয়াশীলতা সব সময়ই ঘাপটি মেরে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রতিনিধিরা ঘাপটি মেরে ছিল। স্বাধীনতা শব্দটি এদের কাছে নতুন এক তিক্ততা এনে দেয়। তাই এরা বেছে নেয় ষড়যন্ত্রের পথ। একের পর এক ষড়যন্ত্রে তারা লিপ্ত হয়। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের হত্যাকাণ্ড স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে তাদের প্রথম বিজয়। সামরিক শাসনের সময় ধর্মের অপব্যবহার দেখা যায় সব সময়ই। যেমনটি দেখা গিয়েছিল ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনের পরে। পাকিস্তানি শাসকেরা সব সময়ই ধর্মের অপব্যবহার করেছে। ধর্মপ্রাণ বাঙালিরা এই চাতুর্য্য টের পেয়ে বলেছিল, ‘ইসলাম খাতরে মে হ্যায়।’

১৯৭৫ সাল–পরবর্তী সামরিক শাসকেরাও একই কায়দায় ধর্মের অপব্যবহার করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রশ্রয় দিয়েছে। ১৯৯০ সালের শেষে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা গেলেও শাসকগোষ্ঠীরা একই কায়দায় জনগোষ্ঠীকে যার যার পক্ষে নিতে চেয়েছে। তারই ধর্মভিত্তিক একটা সংস্কৃতি তারা গড়ে তুলতে চাইছে। নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে গিয়ে তারাও ধর্মকে ব্যবহার করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এর ফলে উদারনীতি কালে কালে মুখ থুবড়ে পড়ল। সাম্প্রতিক নির্বাচনের আগেও সর্বত্র ধর্মসভা এবং মাদ্রাসাভিত্তিক প্রচারণা বড় ভূমিকা পালন করে। কোনো কোনো স্থানে ষোলোই ডিসেম্বর বা পয়লা বৈশাখেও বাঙালির সংস্কৃতির বিপরীতে ওয়াজ মাহফিল ও ধর্মসভাই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। কোনো কোনো সংসদ সদস্য এগুলোকেই নানাভাবে উত্সাহিত করে নিজেদের জনসেবক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার আয়োজনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

এখন পবিত্র রমজান মাস। দ্রব্যমূল্য কমানোর জন্য সরকার বারবার তাগিদ দিচ্ছে। সরকারের অনুরোধ ও আদেশ উপেক্ষা করে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়েই যাচ্ছেন, কিন্তু ধর্ম পালনে কারও কমতি নেই। যাঁরা সত্যিকারের ধার্মিক, তাঁদের ভাগ্যে জুটছে না যথাযথ ইফতারি বা সাহ্​রি। স্বাধীনতার মাস তাহলে কি ব্যবসায়ীদের যথেচ্ছ মুনাফার অধিকারের সময়? স্বাধীনতা কি তাঁদের যেনতেনভাবে অর্থোপার্জনের এবং ভোগের সব অধিকার দেয়? এভাবে যারা প্রচুর মুনাফা করে, তারাই সাধারণত আয়কর ফাঁকি দেয় সবচেয়ে বেশি, দেশ থেকে টাকা শুষে বিদেশে পাচার করে এবং ধর্মের মূল্যবোধ বিরোধী এসব কাজ করে তারাই ধর্ম নিয়ে উচ্চকণ্ঠে কথা বলে। এ আমাদের উপমহাদেশ। মানবিক বা দেশীয় সংস্কৃতির কোনো উপকার এদের দিয়ে হবে না।

জানতে পেরেছি, সৌদি আরবে রোজার সময় জিনিসপত্রের দাম ভীষণভাবে কমে যায়। এ কারণে বহু সৌদি নাগরিক এ সময় বছরের বাজারটা করে ফেলেন। তার মানে, ইসলামি দেশের সংস্কৃতিও এখানকার ব্যবসায়ীরা মানেন না। এর বড় কারণ তাঁরা বহু কষ্টে অর্জিত বাঙালির সংস্কৃতিকে বহু দূরে হটিয়ে দিতে পেরেছেন। তাঁরা এই স্বাধীনতার পূর্ণ অপব্যবহার করেছেন।

কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। পাকিস্তান আমলেও তো এমন অবস্থা ছিল না। কারণ, তখন একটা প্রতিরোধের সংস্কৃতি ছিল। মানুষ প্রশ্ন করত। ভয় ছিল, পাছে ধরা পড়ে যায় যে তারা পাকিস্তানের দোসর। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও দ্রব্যমূল্য তেমন একটা বৃদ্ধি পায়নি। আমরা তখন গ্রাম–গ্রামান্তরে গিয়েছি। বিনা মূল্যেও সবজি পেয়েছি। মাত্র অর্ধশতাব্দীর মধ্যে সেই মানসিকতা কোথায় চলে গেল?

ব্যবসা থেকে আমলাতন্ত্রের মানুষদের, জেলা প্রশাসক থেকে সচিব, ভূমি কর্মকর্তা থেকে তহশিলদার, সিটি করপোরেশন থেকে ওয়াসা–ডেসার কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের কি আমরা এতটাই অতিরিক্ত স্বাধীনতা দিয়েছি যে তাঁরা দুর্নীতি করার যথেচ্ছ সুযোগ পেয়ে গেছেন? কোথাও ঘুষ না হলে কাজ হয় না। ব্যাংক আর শিল্পকারখানার মালিকদের কি আমরা এতটাই স্বাধীনতা দিয়েছি যে তাঁদের অনেকে টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করতে থাকলেও কিছুতেই আর সেটা রোধ করা যাচ্ছে না।

ইয়র্কশায়ারের এক ছিঁচকে মাস্তান শুধু মুর্শিদাবাদের খাজাঞ্চিখানা থেকে কোটি কোটি টাকার হীরা–জহরত লুট করে ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিল, এখন বাংলাদেশের লুটেরারাও বছরের পর বছর একই কাজ করে চলেছে। আমাদের তা মেনেও নিতে হয়েছে। বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কোথাও কার্যকর হচ্ছে না। প্রচুর টাকা বিদেশে ঘরবাড়ি করার জন্য চলে যাচ্ছে, রোধ করার কোনো ব্যবস্থাই নেই। অথচ দিন দিন সাধারণ নাগরিকদের ওপর করের চাপ বাড়ানো হচ্ছে। তা দিয়ে দেখা মুষ্টিমেয় লোকের বিলাসবহুল গাড়ি–বাড়ি হচ্ছে। সুনাগরিকদের জন্য এ দেশে কোনো ব্যবস্থাই ঠিকঠাক চলে না।

স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থার শোচনীয় পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিদিনই খবরের কাগজে নানা নিবন্ধ ও সংবাদ ছাপা হয়। জাতীয় গণমাধ্যমগুলোর স্বাধীনতা কোন অবস্থায় আছে, তা তো আমরা প্রতিমুহূর্তেই বুঝতে পারছি।

এ দেশের মানুষ এবং তাদের সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য একদিন বাঙালি স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছিল। সেই সংগ্রাম ছিল রক্তাক্ত। সেই রক্তাক্ত স্বাধীনতার মূল্য কি আমরা দেব না?

মামুনুর রশীদ: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব