বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) সর্বশেষ লাভের মুখ দেখেছিল ২০০৫-০৬ অর্থবছরে। সেবার প্রায় ৩৬ কোটি টাকা লাভ করেছিল। এরপর গত ১৮ বছরে মোট ৯ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে সরকারের এই প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে এ তথ্য জানা গেছে। বিএসএফআইসি–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটি যেভাবে চলছে, সেভাবে চললে অদূর ভবিষ্যতে লাভের মুখ দেখার সম্ভাবনা খুবই কম।
আর বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কারও মত, এভাবে লোকসানি প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ভিন্নভাবে চিন্তা করতে হবে। কেউ আবার মনে করেন, প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া কোনো সমাধান নয়। লোকসান দেওয়ার কারণ চিহ্নিত করে তা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।
সরকারি চিনিকলগুলো লোকসান দিলেও অপচয় থেমে নেই। সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের কারণে উৎপাদন বন্ধ হওয়া চিনিকলে বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) বসানো হয়েছে। ‘বন্ধ চিনিকলে ইটিপি বসিয়ে অর্থ অপচয়’ শিরোনামে গত বছরের ১৩ আগস্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম আলো। এতে দেখা যায়, ২০২০ সালে উৎপাদন স্থগিত হওয়া ৩ চিনিকলে ইটিপি বসিয়ে ব্যয় করা হয়েছে ২০ কোটি টাকা।
১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বিএসএফআইসির অধীন বর্তমানে ১৬টি কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি চিনিকল। অন্যটি চিনিকলগুলোর যন্ত্রাংশ তৈরি ও মেরামতের প্রতিষ্ঠান রেনউইক যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং (বিডি) লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কেরু অ্যান্ড কোং ছাড়া সব কটিই লোকসান দিচ্ছে।
অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ৩৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা লাভ করে বিএসএফআইসি। এরপর টানা ১৮ বছর সবচেয়ে কম লোকসান দিয়েছে পরের অর্থবছরে (২০০৬-০৭), ১০৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। সরকারি এই প্রতিষ্ঠান গত দেড় যুগে সবচেয়ে বেশি লোকসান দিয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। যার পরিমাণ ১ হাজার ৬৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। গত ১১ অর্থবছরে প্রতিবারই ৫০০ কোটি টাকার ওপর লোকসান দিয়েছে বিএসএফআইসি। সব মিলে ১৮ বছরে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা।
অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ ও বিএসএফআইসির সূত্রে জানা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বার্ষিক লোকসান ছাড়ায় পাঁচ শ কোটি টাকা। দিন যত যেতে থাকে, লোকসান ততই বাড়তে থাকে। এক হাজার কোটি টাকা লোকসান ছাড়ায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। এমন প্রেক্ষাপটে ২০২০ সালে ছয়টি চিনিকলের উৎপাদন স্থগিত করে দেয় সরকার। তারপর লোকসান কিছুটা কমে আসে। গত অর্থবছরে করপোরেশনটি লোকসান দিয়েছে ৫৭১ কোটি টাকার বেশি।
চিনিকলগুলোর লোকসানের কারণ অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে হবে। লোকসানের পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর প্রধান পথ হলো দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে দুর্নীতি-অপরাধের শ্বেতপত্র প্রকাশ করা।অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ
বিএসএফআইসির সচিব চৌধুরী রুহুল আমিন কায়সার প্রথম আলোকে বলেন, চিনিশিল্পকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার জন্য পাঁচ বছরের (২০২২-২৩ মৌসুম থেকে ২০২৬-২৭ মৌসুম) একটি রূপরেখা (রোডম্যাপ) করা হয়েছে। এই রূপরেখা সফল হলে চিনিকলগুলোকে ব্রেক ইভেনে (আয়-ব্যয় সমান) আনা সম্ভব হবে।
রূপরেখা বাস্তবায়ন করে ব্রেক ইভেনে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। রূপরেখার মধ্যে থাকা পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথম অর্থবছরে (২০২২-২৩) প্রায় ৫৩৩ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে বিএসএফআইসি। পরের অর্থবছরে (২০২৩-২৪) সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭১ কোটি টাকায়।
বিএসএফআইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির আয়ের প্রধান উৎস চিনি বিক্রির অর্থ। সেই চিনিরই উৎপাদন কমে গেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে চিনির উৎপাদন হয়েছিল ৮২ হাজার মেট্রিক টন। গত অর্থবছর চিনি উৎপাদিত হয়েছে ৩০ হাজার মেট্রিক টন। কর্মকর্তারা বলছেন, ছয়টি চিনিকলের উৎপাদন স্থগিত করার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক উৎপাদনে। এ ছাড়া ১৫টির মধ্যে ১৩টি চিনিকল স্বাধীনতার আগে প্রতিষ্ঠিত। অধিকাংশ চিনিকলের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে। মেরামত করে এসব চালু রাখা হয়েছে। সক্ষমতা কমে যাওয়ায় চিনিকলগুলো আখ থেকে ঠিকমতো রস বের করতে পারে না। নতুন করে যন্ত্রপাতি স্থাপন ছাড়া চিনির উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বিএসএফআইসির ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা। এই বিশাল অঙ্কের ঋণের সুদই প্রতিবছর আসে পাঁচ শ কোটি টাকার মতো। এই ঋণ ও সুদের কারণে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে লাভে আসা কঠিন বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। গত অর্থবছরও বিএসএফআইসিকে ২৮০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয় সরকার।
লাভে থাকা কারখানাটি নিজের তত্ত্বাবধানে রেখে বিএসএফআইসির কার্যক্রম সার্বিকভাবে সংকুচিত করে আনা দরকার। লোকসানি কারখানার সম্পত্তির হিসাব করে ও দায়দেনা মিটিয়ে এসব জায়গা ইপিজেড বা বিসিককে দেওয়া যেতে পারে।খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি
বিএসএফআইসির বড় আকারের জনবল রয়েছে। স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে বর্তমান কর্মীর সংখ্যা ৭ হাজার ৬৯২। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চিনি বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যায়, তা দিয়ে আখের দামই হয় না। কর্মীদের বেতন-ভাতার জন্য সরকারের কাছে হাত পাততে হয়। অর্থসংকটের কারণে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাওনাও ঠিকমতো দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।
এমন পরিস্থিতিতে বিএসএফআইসির লোকসানি কারখানাগুলো দরপত্রের মাধ্যমে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, লাভে থাকা কারখানাটি নিজের তত্ত্বাবধানে রেখে বিএসএফআইসির কার্যক্রম সার্বিকভাবে সংকুচিত করে আনা দরকার। লোকসানি কারখানার সম্পত্তির হিসাব করে ও দায়দেনা মিটিয়ে দিয়ে এসব জায়গা ইপিজেড বা বিসিককে দেওয়া যেতে পারে। সেখানে চিনি বা অন্য শিল্প হতে পারে।
চিনিকলগুলো বছরে চার মাসের মতো চালু থাকে। বিএসএফআইসির কর্মকর্তারা বলছেন, চিনিকলের উৎপাদন কার্যক্রম সারা বছর চালু রাখা না গেলে এই প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করা সম্ভব নয়। আখের আবাদ কমে যাওয়া, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, আখের উন্নত জাত উদ্ভাবন না করতে পারাকেও সামনের দিনে লাভে ফিরতে না পারার চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন তাঁরা।
তবে চ্যালেঞ্জ যা-ই থাকুক, কারখানা বন্ধ করে দেওয়া কোনো সমাধান নয় বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চিনিকলগুলোর লোকসানের কারণ অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে হবে। লোকসানের পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর প্রধান পথ হলো দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে দুর্নীতি-অপরাধের শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। পাশাপাশি জনস্বার্থের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে নীতিকাঠামোর পরিবর্তন আনতে হবে।