ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের মূল কেন্দ্র উপকূল অতিক্রম করে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে। ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রভাগ সোমবার সন্ধা ছয়টায় ও মূল কেন্দ্র রাত নয়টায় উপকূলে আঘাত করে। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রটি ভোলার ওপর দিয়ে চলে যায়।
ঝড়ের কারণে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের বেশির ভাগ এলাকাজুড়ে ঝোড়ো বাতাস ও ভারী বৃষ্টি হয়। উপকূলের ১৫টি জেলার নদ–নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৫ ফুট উচ্চতা নিয়ে আছড়ে পড়ে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দমকা বাতাসে সোমবার কুমিল্লায় তিনজন, ভোলায় দুজন, সিরাজগঞ্জে দুজন, নড়াইল ও বরগুনায় একজন করে মোট নয়জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। পরিস্থিতির কারণে মঙ্গলবার খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, সোমবার দিবাগত রাতেই ঘূর্ণিঝড়টি রাজধানীর ওপর দিয়ে সিলেট হয়ে ভারতে প্রবেশ করবে। এ সময় এটি স্থল নিম্নচাপে পরিণত হবে। তবে ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে সাগর উত্তাল রয়েছে। ঝড়ের প্রভাবে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত উপকূলসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকাজুড়ে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে।
ঝোড়ো হাওয়া ও ভারী বৃষ্টির আশঙ্কায় আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে চট্টগ্রাম, পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং কক্সবাজার উপকূলসহ দেশের ১৫টি উপকূলীয় জেলাকে ৭ নম্বর বিপৎসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি সোমবার দিবাগত মধ্যরাতের মধ্যে রাজধানী হয়ে সিলেট দিয়ে বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে পারে। এ সময় এটি দুর্বল হয়ে স্থল নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সোমবার রাত সাড়ে নয়টায় কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে বাতাসের গতিবেগ ছিল সবচেয়ে বেশি—ঘণ্টায় ৭৪ কিলোমিটার। এ ছাড়া বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন স্থানে নদ–নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৪ ফুট উচ্চতায় আছড়ে পড়ে। তবে বাতাসের গতিবেগ কম থাকায় জলোচ্ছ্বাসের গতিবেগও ছিল কম।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারী বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বয়ে গেছে। এর ফলে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গাছপালা ভেঙে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। বিশেষ করে ধানমন্ডি লেক, হাতিরঝিলসহ বিভিন্ন সড়কে গাছ পড়ে থাকতে দেখা যায়। চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও খুলনার প্রধান সড়কগুলোর বিভিন্ন স্থানে গাছ ভেঙে পড়ে রয়েছে বলে বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। এর ফলে এসব এলাকায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।
ভারী বৃষ্টি, বিচ্ছিন্ন জনপদ
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে দেশের উপকূলীয় এলাকা অন্যান্য স্থান থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বরিশাল, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বিমানবন্দরে সোমবার বিকেল থেকে উড়োজাহাজ ওঠানামা বন্ধ করে দেওয়া হয়। নৌযান চলাচলও বন্ধ রাখা হয়। প্রবল বৃষ্টির কারণে বেশির ভাগ বাস নির্ধারিত সময়ে দক্ষিণের গন্তব্যে রওনা দিতে পারেনি, গাড়ির সংখ্যাও কমে যায়। সেই সঙ্গে উপকূলের বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ–সংযোগ ছিল না। ফলে উপকূলীয় এলাকাজুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্ভোগ ও আতঙ্ক তৈরি হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ মুহূর্তে দেশের বেশির ভাগ উপকূলীয় এলাকার মাঠে ছিল আমন ধান ও শীতকালীন আগাম সবজি। আর উপকূলীয় প্রায় সব জেলায় মাছের ঘের ও পুকুর রয়েছে। ঝড়, বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে ফসলের পাশাপাশি মাছেরও ক্ষতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কৃষি মন্ত্রণালয় অতিবৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য ৮০ শতাংশ পাকা ধান কেটে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলেছেন, লোকজনকে বাড়িঘর থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে। প্রায় ৭৩ হাজার স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। প্রয়োজনীয় খাবার, নগদ টাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ১৫ জেলায় ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। জেলাগুলো হলো কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি, ভোলা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও বরিশাল।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশের বরিশাল, চট্টগ্রাম উপকূলসহ সারা দেশে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত শুধু পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় ২৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া বরিশালে ২৬১, পটুয়াখালীতে ২৫৩, মোংলায় ২১৯ ও খুলনায় ১৮৭ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। রাজধানীতে সকাল থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ১২৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। ভারী এ বৃষ্টিতে রাজধানীর বেশির ভাগ সড়কে পানি জমে ব্যাপক দুর্ভোগ দেখা দেয়।
অসময়ে ঘূর্ণিঝড়
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, বেশ কয়েকটি কারণে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং ব্যতিক্রমী আচরণ করেছে। প্রথমত, বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড়ের মূল মৌসুম হিসেবে এপ্রিল-মে এবং নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসকে ধরে নেওয়া হয়। এ সময়ে বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। আর বায়ুপ্রবাহের ধরনের কারণে এ চার মাসে বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপ এবং তা থেকে ঘূর্ণিঝড় বেশি তৈরি হয়। দেশে অক্টোবর মাসে সাধারণভাবে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির মতো অনুকূল আবহাওয়া তেমন থাকে না।
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, চলতি মাসের শুরুতেই বঙ্গোপসাগর স্বাভাবিকের বেশি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ফলে চলতি মাসের দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বঙ্গোপসাগরে দুটি লঘুচাপ এবং এর একটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। বাস্তবে হলোও তাই। ফলে চলতি বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা থেকেই যায়। কারণ, ওই সময় ১০ বছর ধরে প্রায় প্রতিবছরই বঙ্গোপসাগরে কমপক্ষে একটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে।
এ ঝড়ের আরেকটি ব্যতিক্রমী আচরণ ছিল এর আঘাতের এলাকা নিয়ে। ১৯৮০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উপকূলে যে কটি বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত করেছে, তার মধ্যে মাত্র দুটি ঝড়ের কেন্দ্রস্থল ছিল বরিশাল ও চট্টগ্রাম অঞ্চল। একটি ১৯৮৫ সালে ও আরেকটি ১৯৯১ সালে। ওই দুটি ঝড়ে বাতাসের গতির চেয়ে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতার কারণে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছিল। এবারও বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূল দিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে।