উষা রঞ্জন পালের ছানার মিষ্টি। সম্প্রতি তোলা
উষা রঞ্জন পালের ছানার মিষ্টি। সম্প্রতি তোলা

এক পদের মিষ্টি দিয়েই মন জয় করলেন উষা রঞ্জন

পুরোনো টিনশেডের একটি দোকান। ভেতরে কয়েকটি নড়বড়ে টেবিল চেয়ার সাজানো। চারদিকে জীর্ণতার ছাপ। তবে সব ছাপিয়ে মিষ্টির মোহন গন্ধ নাকে এসে লাগছে। একপাশে রাখা মচমচে নিমকিও। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলার হারবাং স্টেশন থেকে এক কিলোমিটার দূরে হারবাং বাজারে এই পাল মিষ্টি ভান্ডারের অবস্থান। দুধের ছানা দিয়ে মাত্র এক পদের মিষ্টি বানিয়ে ৫০ বছর ধরে ঐতিহ্য ও সুনাম দুইই ধরে রেখেছেন মিষ্টির কারিগর উষা রঞ্জন পাল।

উষা রঞ্জনের বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার কলাউজানে। তাঁর তিন সন্তানের মধ্যে দুই ছেলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মেয়ে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ১৯৭২ সাল থেকে হারবাং বাজারে মিষ্টি বানান তিনি। দোকানের পেছনেই মিষ্টি তৈরির কারখানা। সেখানে বসে শোনালেন তাঁর জীবনের মিষ্টি গল্প।

উষা রঞ্জন বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবাকে হারাই। সংসারের হাল ধরতে ১৯৫৮ সালে হারবাং বাজারের রেবতী দত্তের ঐতিহ্যবাহী দত্ত মিষ্টি ভান্ডারে চাকরি নিই। তখন আমার বয়স ১৪ বছর। সেখানেই আমার মিষ্টি বানানোর হাতেখড়ি। ১৯৭২ সালে রেবতী দত্ত মিষ্টির দোকানটি বিক্রি করে দেন। আমি দোকানটি কিনে নাম দিই ‘পাল মিষ্টি ভান্ডার’। তখন মাত্র এক আনায় একটি মিষ্টি বিক্রি করতাম। এখন একটি মিষ্টির দাম ১২ টাকা। গত ৫০ বছর ধরে চকরিয়া, পেকুয়া, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, লামাসহ পুরো কক্সবাজার জেলাজুড়ে রাজত্ব করছে আমার এই মিষ্টি।’

বাজারের অন্যান্য মিষ্টির চেয়ে আকারে একটু ছোট পালের মিষ্টি। কিন্তু স্বাদে অতুলনীয়। পুরো এলাকাজুড়ে সুনাম পাল মিষ্টি ভান্ডারের। এই দোকানের মিষ্টি এখন এলাকার ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এলাকার বাইরে থেকেও লোকজন মিষ্টি কিনতে যান সেখানে। চকরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এ কে এম গিয়াস উদ্দিন বলেন, চকরিয়ায় মিষ্টির কথা উঠতেই প্রথম যে নামটি আসে, তা হলো হারবাংয়ের পাল ভান্ডারের মিষ্টি। এই মিষ্টি ছাড়া চকরিয়ার মানুষের মেহমানদারিই অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

উষা রঞ্জন পাল নিজেই মিষ্টির কারিগর। তাঁর দোকানে বর্তমানে চারজন কর্মচারী কাজ করেন। মিষ্টির প্রস্তুত প্রণালি সম্পর্কে উষা রঞ্জন পাল বলেন, দুধ, চিনি, এলাচ ও ময়দা দিয়ে মিষ্টি তৈরি করেন তিনি। এক কেজি ছানার মধ্যে ২০ গ্রাম ময়দা মেশান। ময়দা বেশি মেশালে মিষ্টির গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। দুধ হচ্ছে মূল উপাদান। ছানা কাটা হয় লেবুর রস দিয়ে। মাটির চুলায় কাঠ পুড়িয়ে জ্বাল দেওয়া হয় এই ছানা।

উষা রঞ্জন বলেন, ‘মাত্র ৩০০টি মিষ্টি তৈরি হয় ৪০ কেজি দুধ থেকে। দুধের ঘনত্ব যত বেশি, মিষ্টিও তত সুস্বাদু হয়। দিনে দুধ পাওয়া সাপেক্ষে ১৫-২০ কেজি মিষ্টি বানাই। তবে কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে অর্ডার থাকলে ২০ কেজির বেশিও মিষ্টি বানাই।’

হারবাং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিষদ কার্যালয়ে কোনো অতিথি এলে তাঁকে পাল মিষ্টি ভান্ডারের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এটা আমাদের ঐতিহ্য। অনেক অতিথি এই মিষ্টি খেয়ে পরে অর্ডার করেও নিয়ে যান।’