চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশ চাপে পড়েছেন দেশের দরিদ্র মানুষেরা। বাজার পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষকেরা বলছেন, দামের ‘নাটাই’ মূলত অটো চালকলমালিকদের হাতে। ধানের দাম বেড়ে যাওয়ার ‘অসিলায়’ তাঁরা চালের দাম বাড়াচ্ছেন।
দেশে এখন মোটা চালের কেজি সর্বোচ্চ ৫৫ টাকা, সরু চাল ৮০ টাকা। এদিকে সরকারি গুদামে চালের মজুতও কমতে শুরু করেছে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) হিসাবে, গত আগস্টে দেশের ৩৮ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়েছে। আর দরিদ্রদের ৪৩ শতাংশ ধার করে খাবার কিনে খাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতির জন্য চালের দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন। এ ছাড়া এ ক্ষেত্রে সবজিসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিও ভূমিকা রাখছে।
দেশের চালের বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, মূলত আমন ও বোরো ধান ওঠার আগের সময়ে (এপ্রিল-মে ও অক্টোবর-নভেম্বর) বাজারে চালের কিছুটা ঘাটতি থাকে। এর ফলে এই সময়ে চালের দাম স্বাভাবিকভাবে বাড়ে। আর অসাধু ব্যবসায়ী ও চালকলমালিকেরা সুযোগ নিয়ে এই সময়ে চালের দাম আরও বাড়িয়ে দেন। সরকারের দিক থেকে তদারকির কার্যকর উদ্যোগ না থাকলে বাজার নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে।
আবার দেশে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরও ব্যবসায়ী-চালকলমালিকেরা সুযোগ বুঝে চালের দাম বাড়ান। বিশেষ করে যদি ক্ষমতার পালাবদল হয়।
পরে হয়তো সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ব্যবসায়ী-চালকলমালিকেরা দাম কিছুটা কমিয়ে দেন। কিন্তু ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীরা দাম তিন-চার টাকা বাড়ান। আর সরকার চাপ দিলে তাঁরা দাম কমান এক-দুই টাকা।
চালের বাজারে বর্তমানে এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
উপরন্তু ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী-চালকলমালিকেরা এখন অনেকটাই ‘নিষ্ক্রিয়’ হয়ে পড়েছেন। তাঁদের এই ‘নিষ্ক্রিয়তা’ বাজারে প্রভাব ফেলছে।
২০০৭-০৮ সালে একইভাবে হঠাৎ করে চালের দাম বেড়ে যেতে দেখা গিয়েছিল। তখন ঘাটতি মোকাবিলায় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিদেশ থেকে সময়মতো চাল আনতে পারেনি। এর ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছিল। একইভাবে ২০১৪, ২০১৯ ও ২০২৪ সালের শুরুর দিকে চালের দাম বাড়তে দেখা গিয়েছিল।
দেশের চালের বাজার পর্যবেক্ষণকারী অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ফি বছর এপ্রিল-মে মাসে মাঝারি মানের চাল এবং অক্টোবর-নভেম্বর মাসে মোটা চালের দাম বাড়ে। এ সময় সরকারের দিক থেকে তিন ধরনের উদ্যোগ নিতে দেখা যায়। প্রথমত, অসাধু ব্যবসায়ী ও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী অটো চালকলমালিকদের গুদামে বাড়তি চাল মজুত আছে কি না, তা তদারক করা। দ্বিতীয়ত, মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চালকলমালিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। তৃতীয়ত, চালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় পড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় চালের বরাদ্দ-বণ্টন বাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে বাড়তি চাল বিতরণের কোনো উদ্যোগ এখনো দেখা যাচ্ছে না। যে কারণে বাজারে চালের দাম নিয়ে অস্বস্তি বাড়ছে। বাড়ছে দরিদ্র মানুষের কষ্ট।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারের দিক থেকে চাল আমদানির উদ্যোগও নেওয়া হয়ে থাকে। তবে এবার সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বেশ দেরিতে।
চলতি মাসের শুরুতে চার লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্তের কথা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়। সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত চাল আমদানির জন্য কোনো দেশের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের চুক্তি (জিটুজি) বা উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আমদানির উদ্যোগ শুরু হয়নি।
২০১৯ সালে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের অনুরোধে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় বলা হয়, চালের বাজারে অটো চালকলগুলো সবচেয়ে ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছে, এর সংখ্যা ৯৪৬টি, যার মধ্যে ৫০টি চালকল বেশ বড়। বড় চালকলগুলো মূলত চালের বাজারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। তারা ধান কেনা, মজুত থেকে শুরু করে তা ভাঙিয়ে চালে পরিণত করাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশ অটো, মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির নেতাদের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে অটো চালকলের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে।
অটো মিলের বাইরের বেশির ভাগ চালকল লোকসানে চলে গেছে। অর্ধেকের বেশি বন্ধ হয়ে আছে। এসব চালকলের বড় অংশ নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, দিনাজপুর ও কুষ্টিয়ায় অবস্থিত, এর সংখ্যা প্রায় ১৬ হাজার। এগুলোর মধ্যে মাত্র ৪০০টি কোনোমতে চালু আছে। বাকিরা লোকসান গুনে বন্ধ হয়ে গেছে।
বাজার পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, বাজারে কত দামে চাল বিক্রি হবে, তা বড় চালকলমালিকেরা (অটো মিলমালিক) নির্ধারণ করছেন। এমনকি চাল আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রেও তাঁরা বড় ভূমিকা রাখছেন।
বাজারে বিক্রি হওয়া প্যাকেটজাত চালের বড় অংশ এসব অটো চালকলমালিকদের নিজস্ব ব্র্যান্ড। যেমন বাংলাদেশ অটো, মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদের প্রতিষ্ঠান রশিদ অটো রাইস লি. দেশের সবচেয়ে বড় চালকল। এর নিজস্ব ব্র্যান্ড ‘রশিদের চাল’। মধ্যবিত্তের কেনা মাঝারি ও সরু চালের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী তারা। প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, তারা দেশের মাঝারি চালের ৩০ শতাংশ সরবরাহ করে। দেশের প্রধান চাল রপ্তানিকারকও একই প্রতিষ্ঠান।
মোকামে ধান-চালের একটা বড় চাহিদা মেটায় উত্তরের জেলা নওগাঁ। গত শতাব্দীর আশির দশকের পর এই জেলায় গড়ে ওঠে ছোট-বড় প্রায় ১ হাজার ৮০০টি হাসকিং মিল। কিন্তু অটোমেটিক রাইস মিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে এসব মিলের ৮২ শতাংশ বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে চালের বাজার চলে গেছে গুটিকয় অটো মিলমালিকের নিয়ন্ত্রণে। অন্যদিকে বেকার হয়ে পড়েছেন প্রায় ৩৫ হাজার চাতালশ্রমিক।
খাদ্য অধিদপ্তর ও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে নওগাঁ জেলায় ৩৫৬টি সচল চালকল আছে। এর মধ্যে ৪৪টি অটোমেটিক রাইস মিল, ৩১২টি হাসকিং মিল। গত এক বছরে জেলায় বোরো, আউশ ও আমন মৌসুমে ১৭ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে চালের চাহিদা ছয় লাখ টন। বাকি ১১ লাখ টন ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে সরবরাহ করা হয়।
ছোট ও মাঝারি চালকলগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মূলত বড় অটো চালকলগুলো দাম নির্ধারণে মূল ভূমিকা রাখছে। তারা যখন যে দাম ঠিক করে, সেই দামে মিলগেট, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে চাল বিক্রি হয়। গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এই চালকলগুলোর মালিকেরাই চালের দাম ঠিক করে দিচ্ছেন। দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় চালের দাম তাঁরা অতিরিক্ত বাড়িয়ে দিচ্ছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বাজার পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকেরা।