পরীক্ষা না করেই করোনা শনাক্তের ফল দেওয়ার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা স্বীকার করেছেন সাবরিনা–আরিফ দম্পতি। গোয়েন্দা সদস্যরা তাঁদের মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করার একপর্যায়ে তাঁরা অর্থের লোভে এ কাজ করার কথা স্বীকার করেন।
জিজ্ঞাসাবাদে সাবরিনা চৌধুরী জানান, চিকিৎসক হিসেবে নিজের পরিচয় ও যোগাযোগ কাজ লাগিয়ে করোনা শনাক্তের জন্য নমুনা সংগ্রহের কাজটি জেকেজি হেলথ কেয়ারকে নিয়ে দেন তিনি।
জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহ্বুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সাবরিনা ও আরিফ স্বীকার করেছেন যে তাঁরা টাকার লোভে এ কাজ করেছেন। তবে আরিফ বলেছেন, সাবরিনা বাধা দিলে তিনি এ কাজ করতেন না। আর সাবরিনা বলেছেন, আরিফ এত বেশি পরিমাণে বাড়াবাড়ি করবেন, এটা তিনি বুঝতে পারেননি। তবে তিনি অনেককে করোনা শনাক্তের পরীক্ষা জেকেজিতে করানোর জন্য বলেছেন বলেও স্বীকার করেন সাবরিনা। সাবরিনা চৌধুরী জিজ্ঞাসাবাদে তাঁর পরিচিতি ব্যবহার করে সুবিধা নেওয়ার বেশ কিছু তথ্য প্রকাশ করেছেন, যা তদন্তের স্বার্থে পুলিশ প্রকাশ করতে চায়নি।
বাসা থেকে টাকার বিনিময়ে নমুনা সংগ্রহ করা এবং পরীক্ষা ছাড়াই নমুনার ফল দেওয়ার অভিযোগে তেজগাঁও থানার পুলিশ গত ২৩ জুন জেকেজির সিইও আরিফুল হক চৌধুরীসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১২ জুলাই সাবরিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে বুথ বসিয়ে নমুনা সংগ্রহের কাজ করছিল জেকেজি।
এ কাজ পেতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুজন পরিচালক এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুজন অতিরিক্ত সচিবের সহায়তা পাওয়ার কথা জানিয়েছেন সাবরিনা ও আরিফ।
সাবরিনা চৌধুরী জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ছিলেন। জালিয়াতি ও প্রতারণার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠার পর তাঁকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
জেকেজি হেলথ কেয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুল হক চৌধুরীকে বুধবার চার দিনের রিমান্ডে নেয় ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। একই মামলায় ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও আরিফুলের স্ত্রী সাবরিনা চৌধুরীকেও দ্বিতীয় দফায় শুক্রবার দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। শনিবার আরিফের রিমান্ড শেষ হয়েছে। আজ রোববার সাবরিনার রিমান্ড শেষ হবে। এই দুজনকে কয়েক দফা মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন সাংবাদিকদের বলেন, চিকিৎসক হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন জায়গায় জানাশোনা ও যোগাযোগ ব্যবহার করে তিনি প্রতারণা করেছেন। করোনার এই সময়ে তিনি প্রকল্পটি তৈরি করেন। প্রকল্প অনুযায়ী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে যেভাবে নমুনা সংগ্রহ, পরীক্ষা করা ও সেবা দেওয়ার কথা ছিল, সেভাবে তিনি করেননি।
আবদুল বাতেন বলেন, তদন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তদন্তে যেসব অপরাধমূলক তথ্য–উপাত্ত পাওয়া যাবে, সেগুলোর ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। আর যেগুলো বিভাগীয় অপরাধ ও অনিয়ম সম্পর্কিত, সেগুলো লিখিতভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হবে। এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, সাবরিনা নিশ্চয় কোনো না কোনো জায়গা থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন। তদন্তের জন্য তাঁর অপরাধ কর্মকাণ্ডে সহায়তাকারী বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
পরীক্ষা ছাড়াই নমুনা শনাক্তের ফল দেওয়ার অভিযোগে তেজগাঁও থানায় হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার জেকেজির সাবেক কর্মকর্তা হুমায়ূন কবীর ও তাঁর স্ত্রী তানজিনা পাটোয়ারী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তাঁরা বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহের কথা বলেছেন। এ জন্য বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ও বিদেশিদের কাছ থেকে ১০০ ডলার নিতেন। নমুনা সংগ্রহের পর তা ড্রেনে বা ওয়াশরুমে ফেলে তাঁরা নষ্ট করে ফেলতেন। নমুনা সংগ্রহের সময় তাঁরা শারীরিক লক্ষণের বিষয়ে একটি ফরম পূরণ করতে বলতেন। সেই লক্ষণের আলোকেই নিজেদের মনমতো পরীক্ষার প্রতিবেদন দিতেন বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করা হয়।
গত ১৩ এপ্রিল জেকেজি হেলথকেয়ার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে করোনা শনাক্তের নমুনা সংগ্রহের জন্য বুথ স্থাপনের কাজ শুরু করে। শুরুতে তারা ঢাকায় ৪৬টি এবং ঢাকার বাইরে ৩২০টি বুথ স্থাপনের পরিকল্পনার কথা বলে। কিন্তু ঢাকায় পাঁচটি এবং নারায়ণগঞ্জে দুটি স্থানে নমুনা সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু করে তারা। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং নমুনা সংগ্রহ করে সরকার–নির্ধারিত টেস্ট সেন্টারে পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয় তাঁদের। এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহের সোয়াব স্টিক, ভিটিএম এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রীও তাঁদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সরবরাহ করা হয়।
ঘটনাটি তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকার পাঁচটি বুথ থেকে প্রতিদিন ৪০টি করে ২০০টি নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলো ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু জেকেজি এর চেয়ে বেশি নমুনা পাঠাতে শুরু করে। এমনকি এক দিনে সর্বোচ্চ ৭৯১টি নমুনাও তারা পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছে। ল্যাবরেটরি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশে এই অতিরিক্ত নমুনা নিতে বাধ্য হয় তারা।