সকাল থেকেই ফোন পাচ্ছিলেন একের পর এক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তাঁকে অভিনন্দন জানানো হচ্ছিল। শুধু দেশ থেকে নয়, ফোন আসছিল দেশের বাইরে থেকেও। স্বজন ও বন্ধুবান্ধব এই বিশেষ দিনে খোঁজ নিচ্ছিলেন তাঁর। সবাই তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে ব্যস্ত। বিরাশিতে পা দেওয়া কামাল লোহানী কিন্তু শুভেচ্ছার জবাব দিতে একটুও ক্লান্ত বোধ করেননি। বরং বেঁচে থাকাটা অনেক উপভোগ করছেন, সেটাই জানিয়ে দিলেন সবাইকে।
গতকাল ২৬ জুন তাঁর জন্মদিনে ইফতারের পরপরই কেক কাটা হলো ধানমন্ডির বাসায়। ছিমছাম ছোট পারিবারিক আয়োজন। ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ গানটি পরিবেশন করা হলো সে সময়। এলেন বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, এলেন হায়দার আকবর খান রনো, আশরাফুল আলম, আশফাকুর রহমান, বুলবুল মহলানবীশ, মো. কামালউদ্দীন, শামসুল হুদা প্রমুখ। উদীচী, মানবাধিকার নাট্য পরিষদ, ব্রতচারী বাংলাদেশ, স্বাধীন বাংলা বেতার কর্মী পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন এসে জানিয়ে গেল শুভেচ্ছা। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, নিজে যাকে এখনো মনে করেন সংস্কৃতিকর্মী, সেই কামাল লোহানী ঘরোয়া অনুষ্ঠানে হয়ে রইলেন সবার মধ্যমণি।
কত কিছুই না ঘটল তাঁর জীবনে। পাকিস্তান আমলে বাঙালির ওপর যে শোষণ শুরু হলো, এ ভূখণ্ডের মানুষ হলো যে বঞ্চনার শিকার, তারই সাংস্কৃতিক জবাব যাঁরা দেওয়া শুরু করেছিলেন, তাঁদেরই একজন কামাল লোহানী। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাঁকে পাওয়া গেছে সব সময়। এখনো, এই বিরাশি বছর বয়সেও, তিনি যুবকের মতোই ছুটে চলেছেন দেশের বিভিন্ন এলাকায়। কথায়, কাজে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, সংস্কৃতিহীনতা নিয়ে বেশি দূর এগোতে পারে না জাতি। বুঝিয়ে দিচ্ছেন, নিজের শিকড় আগে আঁকড়ে ধরো, তারপর বিশ্বমানব হও।
পেশা ছিল সাংবাদিকতা। দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তায় করেছেন সাংবাদিকতা। পাশাপাশি ছিলেন দারুণ সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়নিস্ট। সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা হিসেবে সাংবাদিক সমাজের দাবিদাওয়া নিয়ে ছিলেন সোচ্চার। আর সাংস্কৃতিক সংগঠন? ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন উদীচীর সভাপতি। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা। সাংস্কৃতিক সংগঠন ক্রান্তিরও তিনি ছিলেন প্রাণ। আরও কত সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং আছেন!
তাঁর অর্জন নিয়ে অনেক কথাই বলা যাবে, কিন্তু সেটা বলার জায়গা এটা নয়। জন্মদিন নিয়েই কথা হোক আজ।
সন্ধ্যার কিছু পরে অভিনন্দন জানাতে আসা মানুষেরা তো ছিলেনই, কিন্তু উৎসব আরও প্রাণবন্ত হয়েছে সন্তানদের আগমনে। তিন সন্তান সাগর লোহানী, বন্যা লোহানী আর ঊর্মী লোহানীর স্পর্শে পিতা কামাল লোহানী শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পাচ্ছিলেন প্রগাঢ়ভাবে। দুই নাতি-নাতনিও সারাক্ষণ ঘিরে থাকল তাঁকে।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন লাগছে আজ আপনার?’
‘খুব ভালো রে! খুব ভালো!’
‘কত কিছুই তো করলেন জীবনে। আরও কী কী করার ইচ্ছে আছে?’
‘হ্যাঁ, বিরাশি বছর তো বেঁচে আছি। আমি মানুষের জন্য বেঁচে থাকতে চাই। সারা জীবন যে কাজ করেছি, সে কাজ যেন করে যেতে পারি, সেটাই তো চাই। আর হ্যাঁ, দেশের দুরবস্থা, দুর্গতির বিরুদ্ধে নিজেকে যদি সক্রিয় রাখতে না পারি, তাহলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দেওয়াটাই বৃথা হয়ে যায়।’
‘আপনি খুব ভালো থাকুন। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। শতায়ু হোন।’
‘তোরাও ভালো থাকিস!’