‘ভাইয়ে, তুই আমার কণ্ঠ চিনস না। তাড়াতাড়ি ইমোতে অ্যাড কর। ১০ লাখ টাকা লাগবে, ভাই, আমারে মাফিয়া ধরছে, যেফিলে (যেভাবে) পারিস, আমারে বাঁচা।’ লিবিয়া থেকে ইন্টারনেটে যোগাযোগের অ্যাপ ইমোতে পাঠানো অডিও বার্তায় (ভয়েস রেকর্ডিং) এভাবে বাঁচার আকুতি জানিয়েছিলেন মাদারীপুরের তরুণ আসাদুল আকন (১৮)।
গৃহযুদ্ধকবলিত দেশ লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় মিজদা শহরে গত বৃহস্পতিবার ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ অভিবাসীকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নিহত হন মাদারীপুরের ১১ জন। আহত হন ৫ জন। নিহতদের মধ্যে একজন আসাদুল। তিনি রাজৈর উপজেলার রাজেন্দ্র দারাদিয়া এলাকার সিদ্দিক আকনের ছেলে।
নিহত আসাদুলের পরিবার ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ভাগ্যের পরিবর্তন আনতে চার লাখ টাকার বিনিময়ে দালাল তাঁকে চার মাস আগে লিবিয়ায় পাঠায়। তিন মাস লিবিয়াতে কাজ করার পর এক দালালের মাধ্যমে গত ১৬ মে অবৈধ পথে ইতালি যাত্রা করেন আসাদুল। সাগরে ভাসমান নৌকায় ওঠার আগে আসাদুল অপহরণকারীদের হাতে জিম্মি হন। পরে মুক্তিপণের টাকা আদায় করতে আসাদুলের ওপর চালানো হয় নির্মম অত্যাচার।
আসাদুলের পরিবারের ভাষ্যমতে, ১৬ মে আসাদুল তাঁর বড় ভাই শাহাদাত আকনের ইমোতে একটি ভয়েস রেকর্ডিং পাঠান। সে রেকর্ডিংয়ে আসাদুল বলছিলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁদের গেম হবে। অর্থাৎ তাঁদের ইতালির উদ্দেশে যাত্রা শুরু হবে। এরপর ২২ মে আবার ইমোতে একটি ভয়েস রেকর্ডিং আসে। সেখানে আসাদুল জানান, মাফিয়াদের হাতে জিম্মি তিনি। তাকে বাঁচাতে হলে ১২ হাজার ডলার পাঠাতে হবে। না হলে তাঁকে মেরে ফেলা হবে। সবশেষ ২৪ মে শেষবারের মতো আসাদুল তাঁর বড় ভাইয়ের ইমোতে ভয়েস রেকর্ডিং পাঠান। সেখানে আসাদুল বাঁচার আকুতি জানিয়ে কান্নাজনিত কণ্ঠে বলেন, ‘ভাইয়ে, তাড়াতাড়ি জানা কবে টাকা দিবি। ১০ লাখ টাকা লাগবে। আমারে তিন-চার বেলা করে মারে। খাইতে দেয় না। আমারে তোরা বাঁচা।’
শনিবার পর্যন্ত আসাদুলের পরিবার জানত তিনি নিখোঁজ। কিন্তু রোববার সকালে খবর আসে অপহরণকারীদের গুলিতেই আসাদুলের মৃত্যু হয়। তাঁকে লিবিয়ার মাটিতে কবর দেওয়া হচ্ছে। লাশটিও দেশে আনা হচ্ছে না। এ খবর শুনে দিশেহারা হয়ে পড়ে আসাদুলের পরিবার।
রোববার সকালে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, অসুস্থ বাবা বিছানায় বসে সন্তানের জন্য কান্না করছেন। সন্তান বেঁচে নেই শুনে মায়েরও কান্না থামছে না। কিছুক্ষণ পরপর আসাদুলের নাম ধরে চিৎকার করে উঠছেন। বড় ভাইবোনসহ পরিবারের বাকি সদস্যরা শোকে পাথর হয়ে আছেন। আসাদুলের মা শুভতারা বেগম প্রতিবেশীদের কাছে কেঁদে কেঁদে বলছেন, ‘তোমরা আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দাও, আমি আর কিছু চাই না।’
মাফিয়াদের গুলিতে ভাইয়ের মৃত্যু কিছুতেই মানতে পারছেন না আসাদুলের বড় ভাই শাহাদাত আকন। তিনি বলেন, ‘আমরা তিন ভাই, দুই বোন। সবার ছোট আসাদুল খুব আদরের ছিল। সংসারে সবাইকে ভালো রাখতে ও আমরা যেন ভালো-মন্দ খেয়ে-পরে বাঁচতে পারি, তাই বিদেশে যায়। কিন্তু শেষ পরিণতি যে এমন ভয়ানক হবে, তা আমরা কল্পনাও করি নাই। ভাইটার লাশও শেষ দেখা দেখতে পারলাম না।’
জানতে চাইলে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) আবদুল হান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাদারীপুরের নিহত ১১ জনের নাম আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে ১০ জনের পরিচয় আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি। একজনের এখনো নিশ্চিত করতে পারিনি। এ জেলায় আহত পাঁচজনের নামও রয়েছে। আমরা তাঁদেরও চিহ্নিত করেছি।’
আবদুল হান্নান আরও বলেন, ১১ জন নিহতের মধ্যে সিংহভাগ রাজৈর উপজেলার বাসিন্দা। তাই রোববার সকালে রাজৈর থানায় এ-সংক্রান্ত একটি মামলা হয়েছে। সদর থানাতেও একটি মামলা হবে। জেলায় মানব পাচার চক্রের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করতে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।