>
- সরকারি টাকায় বিদেশে যাচ্ছেন ১৯১ জন
- তাঁদের ৪১ শতাংশ উচ্চমান সহকারী থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা
মো. আবু সোহেল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (প্রশাসন) অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর। ৫ মার্চ সরকারি আদেশ হয়েছে, তাঁকে মালয়েশিয়া যেতে হবে প্রশিক্ষণ নিতে। প্রশিক্ষণের বিষয়: ‘দ্য এক্সপোজার ভিজিট অব মেডিকেল এডুকেশন অ্যান্ড হেলথ ম্যানপাওয়ার ডেভেলপমেন্ট পারসোন্যাল অব আপডেট এক্সামিনেশন অ্যাসেসমেন্ট সিস্টেম’। বাংলায় বলা যায়, চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন কর্মীদের আধুনিক পরীক্ষা মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিদর্শন।
২১ মার্চ সন্ধ্যায় মুঠোফোনে মো. আবু সোহেলের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। কী বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে মালয়েশিয়া যাচ্ছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বলতে পারব না, ইংরেজিতে চিঠি আইছে।’ ‘আপনাকে কারা পাঠাচ্ছে?’ উত্তরে সোহেল বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।’ ‘প্রশিক্ষণে যাওয়ার জন্য আপনি কি দরখাস্ত করেছিলেন?’ সোহেল বললেন, ‘আমি কোনো দরখাস্ত করি নাই। গত বছর যারা যায় নাই, তারা এবার যাচ্ছে। দরখাস্ত লাগে না।’
৫ ও ৬ মার্চ বিদেশে প্রশিক্ষণের ২০টি সরকারি আদেশ হয়েছে। আদেশগুলো স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে আছে। এসব আদেশবলে দক্ষিণ কোরিয়ায় ৬ জন, ইন্দোনেশিয়ায় ৫৬ জন ও মালয়েশিয়ায় ১২৯ জনের প্রশিক্ষণে যাওয়ার কথা। মোট ১৯১ জনের মধ্যে ৭৮ জন বা ৪১ শতাংশ হচ্ছে উচ্চমান সহকারী, কম্পিউটার অপারেটর, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর, স্টেনোগ্রাফার, স্টেনোটাইপিস্ট কাম কম্পিউটার অপারেটর, হিসাব কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা।
চিকিৎসা শিক্ষা বিভাগের বিদেশ প্রশিক্ষণে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে অধিদপ্তরের বরাদ্দ ১১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা বলে তিনি জানান। এর বাইরে মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ আছে। সব মিলে প্রায় ২০ কোটি টাকা। এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৪২৬ জনকে বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত আছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা কর্মপরিকল্পনা (অপারেশনাল প্ল্যান) থেকে এই প্রশিক্ষণের আয়োজন ও ব্যয় নির্বাহ করা হয়। ২১ মার্চ বেলা ১১টায় কর্মপরিকল্পনার পরিচালক অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর দপ্তরে কথা হয়। তিনি বলেন, প্রশিক্ষণের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। কিছুদিন আগে দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি প্রতিবেদককে অপেক্ষা করতে বলেন।
বেলা সোয়া তিনটায় কর্মপরিকল্পনার কর্মসূচি ব্যবস্থাপক নাসির উদ্দিন ও উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক ইবনুল হাসান ওই কক্ষে আসেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, চিকিৎসা শিক্ষা বিভাগের বিদেশে প্রশিক্ষণের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব মূলত ইবনুল হাসানের।
ইবনুল হাসান বলেন, সরকারের যেকোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারী বিদেশে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। যুগ্ম সচিব, মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ও উচ্চমান সহকারীকে একই প্রশিক্ষণে বিদেশে পাঠানোর যৌক্তিকতা সম্পর্কে তিনি বলেন, কর্মসূচির প্রয়োজনে সবাইকে পাঠানো হয়, চিকিৎসা শিক্ষাবিষয়ক প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা সবারই দরকার।
প্রশিক্ষণের জন্য এ বছর মন্ত্রণালয় এখনো অর্থ ছাড় দেয়নি, তাহলে বিমানভাড়া, হোটেল খরচ কীভাবে মেটানো হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তরে ইবনুল হাসান বলেন, ‘প্রত্যেকে নিজের খরচে যাচ্ছেন। ফিরে এসে বিল জমা দিয়ে টাকা তুলে নেবেন।’
প্রশিক্ষণার্থীর বাছাইপ্রক্রিয়া সম্পর্কে এই সরকারি কর্মকর্তা বলেন, নির্দিষ্ট বিষয়ে আবেদনকারীদের বাছাইপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন করা হয়। এ বিষয়ে তাঁদের দপ্তরে একটি কমিটি আছে বলেও তিনি জানান। তবে এটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত কোনো কমিটি নয়।
কথাবার্তার একপর্যায়ে কাগজপত্র দেখতে চাইলে ইবনুল হাসান তা দেখাতে অস্বীকৃতি জানান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রধান সহকারী সৈয়দ জালালের আবেদনপত্র দেখতে চাইলে তিনি বলেন, সৈয়দ জালাল গত বছর আবেদন করেছিলেন। অসুস্থতার জন্য যেতে পারেননি। এবার যাবেন। অফিস সহকারী শামীম হাসান, মো. আবু সোহেলের আবেদনপত্র দেখতে চাইলে তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের লিখিত আদেশ লাগবে।
গল্প আলাদা
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের নাক কান গলা বিভাগের অধ্যাপক মণিলাল আইচসহ ১৮ জন ইন্দোনেশিয়া গেছেন স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের নেতৃত্ব ও সুশাসন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে। ২২ মার্চ দেশ ছাড়ার আগে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিমানের টিকিট, হোটেলভাড়া সবই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বহন করছে। সম্মানী কত দেবে, জানি না।’
একই কলেজের একসময়ের ছাত্রনেতা ও বর্তমানে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মো. জুলফিকার লেনিন চিকিৎসা শিক্ষায় শিখন প্রযুক্তির বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে যাবেন মালয়েশিয়ায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রশিক্ষণের জন্য তিনি কোনো আবেদন করেননি। তবে পাসপোর্ট-ভিসা ও উড়োজাহাজের টিকিট হাতে দেওয়ার সময় অধিদপ্তরের লোকজন আবেদনের একটি কাগজে স্বাক্ষর করে নেবেন। অতীতেও এমন হয়েছে।
মালয়েশিয়ার প্রশিক্ষণার্থীদের এই দলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচ্চমান সহকারীসহ ২১ জনের নাম আছে। মো. জুলফিকার লেনিন বলেন, ‘উচ্চমান সহকারী, অফিস সহকারী বা কম্পিউটার অপারেটরদের এই প্রশিক্ষণে পাঠানোর যৌক্তিকতা বুঝতে পারছি না।’
এই প্রতিবেদক কমপক্ষে ২০ জন কর্মকর্তা, অধ্যক্ষ, অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, কর্মচারীর সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়ে কথা বলেছেন। দুজন ছাড়া তাঁরা কেউই বিদেশে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য আবেদন করেননি, তাঁরা কেউই প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি, তাঁরা কেউই নিজে আগাম খরচ করে বিদেশ যাচ্ছেন না। সব ব্যবস্থা করেছেন ইবনুল হাসান ও তাঁর দপ্তর।
কত খরচ
দক্ষিণ কোরিয়ার সফরটি ছিল ছয় দিনের। বাকি ১৯টি সফরের প্রতিটি সাত দিনের। যাওয়া ও আসার দুই দিনও প্রশিক্ষণকালের অন্তর্ভুক্ত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, মালয়েশিয়ার একজন প্রশিক্ষণার্থীর পেছনে গড়ে ব্যয় হবে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এর মধ্যে বিমানভাড়া ৩০ হাজার এবং হোটেলভাড়া ও হাতখরচ ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। ইন্দোনেশিয়ায় একজন প্রশিক্ষণার্থীর পেছনে গড়ে ব্যয় হবে দেড় লাখ টাকা। এর মধ্যে বিমানভাড়া ৪০ হাজার এবং হোটেলভাড়া ও হাতখরচ ১ লাখ ১০ হাজার টাকা।
এসব খরচের সঙ্গে যুক্ত হবে প্রশিক্ষণ ফি। এই ফি দিতে হবে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিকে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অনুমিত হিসাব বলছে, দুই দেশের প্রশিক্ষণে সর্বোচ্চ ৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা খরচ হওয়ার কথা। গত বছর তিন শর কিছু বেশি প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন। খরচ দেখানো হয়েছিল প্রায় ৮ কোটি টাকা। এবার প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা বেশি, খরচও বেশি দেখানো হবে।
গত বছর কী হয়েছিল
গত বছরও থাইল্যান্ডে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার ওপর প্রশিক্ষণে গিয়েছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন উচ্চমান সহকারী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেছেন, প্রশিক্ষণে এক দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ক্লাসে বসে ছিলেন। বাকি দিনগুলো হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখেছেন। তিনি এ বছরও মালয়েশিয়া যাচ্ছেন।
এ ধরনের প্রশিক্ষণের কোনো দরকার নেই বলে মন্তব্য করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহ-উপাচার্য ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এসব প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয় না। এর মাধ্যমে প্রশাসনের কিছু মানুষকে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ দেওয়া হয়। ৪-৫ দিনের প্রশিক্ষণে গুরুত্ব দিয়ে কিছু শেখাও যায় না। ফলে স্বাস্থ্যের বা চিকিৎসা শিক্ষার কোনো লাভ হয় না। কেউ কেউ হয়তো লাভবান হন।
আরও পড়ুন
কেমন ডাক্তার তৈরি হচ্ছে?
https://www.prothomalo.com/education/article/1585146/