'নিহত ও নিখোঁজ' ব্যক্তিদের তালিকা করছে হেফাজত

মতিঝিলের শাপলা চত্বরে গত ৫ মে মধ্যরাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ‘নিহত ও নিখোঁজ’ ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির কাজ করছে হেফাজতে ইসলাম। তারা গতকাল পর্যন্ত ৭৩ জন নিহত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত তথ্য পেয়েছে বলে দাবি করেছে। শাপলা চত্বর অভিযানের এক মাসের মাথায় হেফাজতে ইসলামের ঢাকা ও চট্টগ্রামের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা প্রথম আলোকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

সংগঠনের শীর্ষপর্যায়ের সূত্রগুলো জানায়, হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় দপ্তর ঈদের পর চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় সংবাদ সম্মেলন ডেকে নিহত ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করবে। প্রশাসনের চাপ এবং ‘নিহত’ ব্যক্তিদের পরিবারের অনুরোধের কারণে সময় নেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করেন নেতারা।

কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে প্রায় দুই মাস ধরে আন্দোলনের পর হেফাজতে ইসলামের লাখ লাখ কর্মী-সমর্থক গত ৫ মে ঢাকার ছয় প্রবেশমুখে অবরোধ কর্মসূচি শেষে শাপলা চত্বরে অবস্থান নেন। মধ্যরাতে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির যৌথ অভিযানের মুখে এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হন তাঁরা।

ঘটনার পর ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরে ৭ মে এক বিবৃতিতে হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী দাবি করেছিলেন, অভিযানের সময় অন্তত আড়াই থেকে তিন হাজার লোক মারা গেছেন। একই রকম দাবি করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীও। তবে এখন পর্যন্ত অভিযানে ‘নিহত বা নিখোঁজ’ ব্যক্তিদের কোনো তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি হেফাজতে ইসলাম। এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় গিয়ে সংগঠনের আমির আহমদ শফীসহ ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের শীর্ষপর্যায়ের একাধিক দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে সরাসরি এবং মুঠোফোনে কথা বলেন এ প্রতিবেদক।

কয়েক হাজার লোক নিহত হওয়ার দাবির বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিলে গত শনিবার শাহ আহমদ শফী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত লোক না মারলে বাতি নিভাইলো কেন? রাতে রাস্তা ধুইলো কেন? কত লোক মারছে, কত গুলি করেছে; এটা তো সরকার বলবে।’

সরকারি প্রেসনোটে বলা হয়েছিল, একজনও মারা যায়নি—এ কথা স্মরণ করিয়ে দিলে আহমদ শফী বলেন, ‘হিসাব দিতে হবে, সে সময় আসবে।’

হেফাজতে ইসলামের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, ৫ মে রাতের অভিযানে ‘নিহত বা নিখোঁজ’ ব্যক্তিদের তালিকা করতে হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক ফোরকান আহমদের নেতৃত্বে প্রথমে সাত সদস্যের কমিটি করা হয়। পরে তাঁকে অব্যাহতি দিয়ে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়। বর্তমান কমিটি তালিকা তৈরির কাজ করছে। এর সদস্যরা হলেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী, সংগঠনের ঢাকা মহানগর কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মাহফুজুল হক ও মিরপুরের একটি মাদ্রাসার শিক্ষক ফজলুল করিম। কমিটির দুজন সদস্যের সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়।

জানতে চাইলে আজিজুল হক ইসলামাবাদী গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশাসনের চাপ ও হয়রানির কারণে আমরা ঠিকমতো তথ্য সংগ্রহ করতে পারছি না।’ এ পর্যন্ত ৭৩ জন নিহত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পেরেছেন দাবি করে তিনি বলেন, আরও ৪৮ জনের নাম কমিটির কাছে জমা পড়েছে। তবে এগুলো এখনো যাচাই করে দেখা সম্ভব হয়নি।

৮ মে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার (ডিএমপি) বেনজীর আহমেদ হেফাজতের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, দু-তিন হাজার লোক মারা গেছে বলে যে গুজব ছাড়ানো হচ্ছে, তার কোনো ভিত্তি নেই। তিনি প্রশ্ন তোলেন, এত লোক মারা গেলে তাঁদের স্বজনেরা কোথায়?

পরে ১০ মে সরকারি প্রেসনোটে বলা হয়, অভিযানকালে মঞ্চের পাশে কাফনের কাপড় মোড়ানো চারটি লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ ছাড়া সারা দিন বিভিন্ন পর্যায়ের সংঘাতে তিনজন পথচারী, একজন পুলিশসহ মোট ১১ জন নিহত হন।

সাংগঠনিক অবস্থা নাজুক: সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, ৫ মের আগ পর্যন্ত হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস ও উত্তেজনা ছিল, শাপলা চত্বরের অভিযানের পর তাতে ছেদ পড়েছে। এর সঙ্গে মামলার খড়্গ, গ্রেপ্তারের আতঙ্কে গুরুত্বপূর্ণ নেতারা গা ঢাকা দিয়ে আছেন। বিভিন্ন মাদ্রাসায় পুলিশের হয়রানি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের নানামুখী চাপ যুক্ত হয়ে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একরকম হতাশার সৃষ্টি হয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে সাংগঠনিকভাবে খুব নাজুক অবস্থায় আছে হেফাজতে ইসলাম। এ অবস্থা কাটিয়ে আবার সংগঠিত হওয়ার জোর চেষ্টা করছে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটি। এ জন্য রোজার পর সংগঠিত কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা করছে।

হেফাজতে ইসলামের ঢাকা ও চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় অন্তত ১০ জন নেতার সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, সংগঠনটি এখন তিনটি বিষয় সামনে রেখে ব্যস্ত আছে। প্রথমত, ১১ জুন থেকে শুরু হতে যাওয়া কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন পরীক্ষা শেষ করা; দ্বিতীয়ত, ‘নিহত ও নিখোঁজদের’ পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা; তৃতীয়ত, সারা দেশের বিশিষ্ট আলেমদের সম্মেলন আহ্বান করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা। এ তিনটি কাজ রোজার মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। শনিবার এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে হেফাজতের আমির আগামী দিনে আরও জোরালো আন্দোলনের মনোভাব ব্যক্ত করেন। তবে এই মুহূর্তে মাঠপর্যায়ের কর্মসূচিতে যাওয়ার সম্ভাবনা কম বলে তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা জানান। বাবুনগরীর জবানবন্দির কিছু বক্তব্যের সঙ্গে একমত: হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী ৮ মে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) জিজ্ঞাসাবাদে দেওয়া কিছু তথ্য এবং গত ২১ মে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, তার কিছু বক্তব্যের সত্যতা থাকতে পারে বলে ধারণা করেন সংগঠনের কয়েকজন নেতা।

জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, ৫ মের সমাবেশের ওপর তাঁদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন হেফাজতের ১৮-দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর নেতারা।

আলাপকালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন নেতা বলেন, হেফাজতে ইসলামের পুরো আন্দোলনে সংগঠনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাঈনুদ্দীন রুহী ও সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী, ঢাকা মহানগর কমিটির সদস্যসচিব জুনাইদ আল হাবিব প্রমুখ নেতার প্রভাব ছিল। এসব নেতা বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটেও রয়েছেন। ওই দিন শাপলা চত্বরের মঞ্চেও তাঁদের নিয়ন্ত্রণ ছিল। এ ছাড়া অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে পুরানা পল্টন, বায়তুল মোকাররম ও বিজয়নগর এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও গাছ কাটার ঘটনায় ছাত্রদল, যুবদল ও জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে হেফাজতের কিছু কর্মীর অংশগ্রহণ ছিল। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের আক্রমণের শিকার হয়ে ক্ষুব্ধ একটি অংশ সংঘর্ষে জড়ায় বলে ওই দুই নেতা মনে করেন। তাঁদের দাবি, দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, গাড়ি ও ভবনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় হেফাজতের কর্মীরা জড়িত ছিলেন না।