'নামর শঅর, অবস্থা গ্রামত্তুনও খারাফ'

চান্দগাঁওয়ের নাজিরবাড়ি পার হতেই ইটের সড়কের শুরু। এই সড়ক ধরে ১০০ গজ যেতেই সড়কে আর ইটের দেখা নেই। হামিদচর পর্যন্ত আধা কিলোমিটার সড়কজুড়ে শুধু মাটির রাজত্ব। শুষ্ক মৌসুমে এবড়োখেবড়ো সেই মেঠো পথ ধরে মানুষের চলাফেরার একটিই মাধ্যম—ব্যাটারিচালিত রিকশা। আর বর্ষা এলে—কেবল দুটো পা।

এই দুটি এলাকার মানুষের জীবনধারাও যেন সড়কের মতো দুর্দশায় ভরা। ওয়াসার পানি সেখানে দূর অস্ত, প্রয়োজনীয় নলকূপও নেই। সার বেঁধে সংগ্রহ করতে হয় পানি। আর রান্না, গোসল কিংবা ব্যবহারের জন্য একমাত্র ভরসা ময়লা-আবর্জনায় ভরা মজা পুকুরগুলো। 

চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) আসনে পড়া এই অংশের অবস্থান চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও ওয়ার্ডে। শহরের বাসিন্দা হয়েও এই দুটি এলাকার মানুষের বাস যেন অজপাড়াগাঁয়ে।

এবার আসা যাক বোয়ালখালী অংশের দিকে। উপজেলা সদর থেকে সড়ক যতই কদুরখিল হয়ে চরণদ্বীপের দিকে এগোচ্ছে, ততই বদলে যাচ্ছে চেহারা। ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে সড়কের আকার। একটু পরপর নলকূপ। একই চিত্র ছিল চরণদ্বীপ থেকে ছন্দারিয়া যাওয়ার প্রায় ১০ কিলোমিটারের পথটাও। পুরোটাই নির্বিঘ্ন যাত্রা।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে হামিদচরের আবর্জনায় ঠাসা কালো পানির একটি পুকুরে গোসল সারছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব রাজমিস্ত্রি মোহাম্মদ আবছার। চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইতেই যেন ক্ষোভের খই ফুটল তাঁর কণ্ঠে। তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলতে শুরু করেন, ‘নামর শঅর। আরার অবস্থা বোয়ালখালীর গ্রামত্তুনও খারাফ। নলকূপের জন্য এমপির হাচে গেলে বলে, কাউন্সিলর কাছে য। আবার কাউন্সিলের কাছে যাইলে বলে, এমপির কাছে য। আরার হতা ফুনিবার কেয়া নাই। তাই ভোট লই হন আগ্রহ নাই।’ 

আবছারের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে এবার শুরু করলেন তরুণ সাইদুল হক। এলাকার বঞ্চনার কথা শোনাতে যেন তাঁরও ক্লান্তি নেই। সড়কের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে ওঠেন, ‘এটি কোনো সড়ক হলো? বর্ষাকালে কোনো প্রসূতি রোগীকে নাজিরবাড়ি হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা তার আশপাশের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায় না। যেতে হয় তিন কিলোমিটার বাড়তি পথ—সিঅ্যান্ডবি ঘুরে। তা–ও রিকশায় চড়ে মূল সড়কে উঠতে হয়। স্থানীয় কিংবা জাতীয় নির্বাচন এলে শুধু প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতি শুনি, পরে আর কেউ আমাদের মনে রাখে না।’

একই অবস্থা দেখা গেছে এই আসনের চট্টগ্রাম নগরে পড়া মোহরা, চান্দগাঁও ওয়ার্ডের অন্য এলাকাগুলোতেও। অথচ চট্টগ্রাম-৮ আসনের দুই–তৃতীয়াংশ ভোটারই নগরের বাসিন্দা। মোট ভোটারের ৩ লাখ ১১ হাজার ৮৬৫ জনই নগরের অংশের। আর মাত্র ১ লাখ ৬৪ হাজার ১৩১ ভোটার বোয়ালখালী অংশের। 

বোয়ালখালী অংশের মানুষের কাছে কালুরঘাট সেতু ছাড়া অন্য উন্নয়ন নিয়ে বড় দুঃখবোধ নেই। কিন্তু শহরের অংশের মানুষের কাছে সড়ক আর জীবনযাত্রা নিয়ে শুধু অভিযোগ আর অভিযোগ।

এই আসনের উপজেলা পরিষদ, কদুরখীল, হামিদচর ও পাটানিয়া গোদা এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার ১২ জন মানুষের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা জানান, এই আসনে যাঁরা সাংসদ হন, তাঁদের প্রায় সবার নজর থাকে বোয়ালখালী অংশের দিকে। তাই যাবতীয় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে সেখানেই। শহরের অংশের দিকে তাঁরা তেমন চোখ দেন না। আবার যাঁরা এসব ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, তাঁরাও প্রান্তিক এই এলাকাগুলোর উন্নয়ন নিয়ে তেমন ভাবেন না।

সাংসদ মইন উদ্দীন খান বাদলের মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হয়। ১৩ জানুয়ারি এখানে উপনির্বাচন। ছয়জন প্রার্থী থাকলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগের মোছলেম উদ্দিন আহমদের সঙ্গে বিএনপির আবু সুফিয়ানের। মাত্র কয়েক দিন পর নির্বাচন হলেও মানুষের মধ্যে এ নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই। পথে পথে ঝুলে থাকা প্রার্থীদের পোস্টারগুলোই শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছে নির্বাচনের কথা।

নদীভাঙন
বোয়ালখালীর চরণদ্বীপ ইউনিয়নের ঘাটিয়ালপাড়া পার হয়ে পশ্চিমে যেতেই কর্ণফুলী নদী। নদীর বুকে ইঞ্জিনচালিত নৌকার মিছিল। সেগুলো কিন্তু মাছ ধরছে না। ব্যস্ত বালু উত্তোলনে। এভাবে নির্বিচারে বালু উত্তোলন শুধু নদীর দুঃখ বাড়াচ্ছে তা নয়, একই কারণে নদীর পূর্ব পারের মানুষের জীবনও ক্রমশ ঝুঁকির হয়ে উঠছে। একদিকে বালু উত্তোলন, অন্যদিকে নদীর পাড়ে ব্লক না ফেলায় ইতিমধ্যে ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধ সড়কটির একাংশ। ভাঙন ৫০ গজ এগোতে পারলেই ধরে ফেলবে বাড়ি-ঘরকে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে কালুরঘাট সেতু এলাকা থেকে চরণদ্বীপের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নদীর পাড়ে ব্লক ফেলার কাজ চলছে কয়েক বছর ধরে। কিন্তু এখনো মাঝখানের ঘাটিয়ালপাড়ার প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ব্লক পড়েনি। ফলে নদীর পানি এগোচ্ছে ঘাটিয়ালপাড়ার দিকে।

এ জন্য ঘাটিয়ালপাড়ার বাসিন্দা ছাবেরা খাতুনের চোখে এখন কেবল আতঙ্ক। ভিটেমাটি হারানোর আশঙ্কায় এই নারীর কাটছে দিন। বলেন, ‘এক টুকরো জমি ছিল। সেটি আগেই খেয়ে ফেলেছে নদী। এখন মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু হারিয়ে ফেললে যাব কোথায়?’

একই এলাকার বাসিন্দা মীর হোসেন মনে করেন, নির্বিচারে বালু উত্তোলনের কারণেই এই ভাঙন। তিনি বলেন, ‘নদীর পাড়ে এসে প্রতিদিন বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এর ফলে বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। আমরা সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে প্রতিবাদ করলে নৌকাগুলো চলে যায়। কিন্তু আবার রাতে এসে বালু উত্তোলন করে। যিনি এবার সাংসদ হবেন, তিনি যেন আমাদের ভিটেমাটি রক্ষার উদ্যোগ নেন।’