গত বুধবার সাহরির পরে দালালের চোখ ফাঁকি দিয়ে ফোন করেছিলেন সজীব হোসেন (২১), যা ছিল পরিবারের সঙ্গে সজীবের শেষ কথা। সজীব তাঁর মাকে বলছিলেন, ‘চার মাস পর দালাল আমাকে নৌকায় ওঠাবে। মা, তুমি ভালো থেকো। আমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া কইরো।’ এরপর থেকে সজীবের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই।
গত সোমবার রাতে ইতালিতে থাকা স্বজনেরা জানান, সজীবকে বহন করা নৌকাটি লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে তিউনিসিয়ায় সাগরে ডুবে যায়। এতে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি মারা গেছেন। ওই নৌকায় সজীবও ছিলেন। এরপর থেকে মা বিবি বেগম আর একমাত্র বোন মিমের বিলাপ যেন থামছেই না।
সজীব হোসেন মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের উত্তর শিরখাড়া এলাকায় আজিজ শিকদারের ছেলে।
সজীবের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির চারপাশে মানুষের ভিড়। সজীবের মা ও বোন একটু পরপরই সজীবের ছবি বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেই যাচ্ছেন। ছেলে আর বেঁচে নেই—এটি কিছুতেই মানতে পারছেন না এই মা। শোকসন্তপ্ত পরিবারটির এমন অবস্থা দেখে স্থানীয় লোকজনের মধ্যেও বইছে শোকের মাতম।
সজীবের স্বজনেরা জানান, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা না দিয়েই গত ঈদের পরের দিন এক দালালের হাত ধরে লিবিয়া যান সজীব। লিবিয়ায় ছয় মাস কাজ করার পর নোয়াখালীর রুমান নামের এক দালালের খপ্পরে পড়েন সজীব। সেই দালাল আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে সজীবকে ইতালি নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। সজীব রাজি হন তাঁর সঙ্গে যেতে। এরপর দালাল টাকা আটকে রেখে সজীবকে লিবিয়ায় বন্দী করে রাখেন। দীর্ঘ চার মাস পরে গত বৃহস্পতিবার অবৈধ পথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে লিবিয়া পৌঁছানোর কথা বলে সজীবকে নৌকা তোলা হয়।
সজীবেরা তিন ভাই, এক বোন। সবার ছোট সজীব। তাঁর বড় ভাই শারীরিক প্রতিবন্ধী। মেজ ভাই ইতালিপ্রবাসী। ছেলে সজীবের সঙ্গে শেষ কথা বলা ফোনটি হাতে নিয়ে মা আহাজারি করতে করতে বলছিলেন, ‘আমার সোনার পুতের কী হইলো? ওরে ওই...দালালে আটকাইয়া রাখত। কেন ওরে নিয়া গেল সাগরে? কেন আমার বাজানডা চইলা গেল। আমার বাজানরে তোমরা আইনা দাও। আমার বাজানে শেষ কথায় আমারে কইছিল, মা, তুমি ভালো থাইকো। আমাগো দালালে বৃহস্পতিবার নৌকায় উঠাইবো।’
সজীবের বোন মিম আক্তার বলেন, ‘আমারে আফা কইয়া আর কে বোলাবো। আমার ভাইরে এক বছর রাইখা কেন বৃহস্পতিবার পাঠাইলি। আমি এহন কেমনে ভাইরে ভুইলা থাকমুরে। কোথায় গেলি সজীবরে।’
সজীবের সঙ্গে ওই নৌকায় ছিলেন একই ইউনিয়নের আরও দুজন। তাঁরা হলেন বল্লভদী এলাকার আদেল উদ্দিন মাতুব্বরের ছেলে মনির হোসেন মাতুব্বর (২২) ও শ্রীনদী এলাকার জোবায়ের মাতুব্বরের ছেলে নাদিম মাতুব্বর (১৭)। ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে তাঁরাও নিখোঁজ। এখন পর্যন্ত তাঁদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া একই ঘটনায় সদর উপজেলার মঠেরবাজার এলাকার মজিবুর রহমানের ছেলে সাইফুল ইসলামও (২৪) নিখোঁজ।
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি মাদারীপুর শাখার যুবপ্রধান শিশির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তিউনিসিয়ার উপকূলের কাছে নৌকাডুবির ঘটনায় এ পর্যন্ত চারজনের নাম পেয়েছি। এর মধ্যে তিনজন নিখোঁজ আর সজীব নামের একজনের নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হতে পেরেছি। আমরা নিহত ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের বাড়িতে গিয়ে তথ্য নিয়েছি।’