ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ অফিসে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রাক্-মনোনয়ন নির্বাচনী তৎপরতা দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে পৌঁছে প্রথমেই চোখে পড়ল একজন ভদ্রমহিলার হাতে একটা ফুলের তৈরি নৌকা। তিনিই মনোনয়নপ্রত্যাশী। তাঁর সমর্থক হাতে গোনা কয়েকজন। কিন্তু ফুলশোভিত নৌকার কারণে তাঁকে ঘিরে জটলা ছিল। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা নেতা-কর্মীর ভিড়। কেউ সেলফি তুলছিলেন।
তিনি শাহনাজ হোসেন। আমাকে কার্ড দিলেন। বাংলাদেশ তৃণমূল লীগের চেয়ারম্যান তিনি। ভাগ্যিস, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুসারী, তা বলা যাবে না। হলে তিনি হয়তো তৃণমূল আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান বনে যেতেন। অত্যন্ত অনুগত নেত্রীর মতোই সিরিয়াস মুখে বললেন, মনোনয়ন ফরম কিনেছেন বটে; কিন্তু তিনি একটুও ব্যথা পাবেন না। নেত্রী যাঁকে দেবেন, দলের বৃহত্তর স্বার্থে তাঁর পক্ষেই তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন।
তবে এটা যে-সে ব্যাপার নয়, তৃণমূল লীগের অফিসের ঠিকানা খোদ ১৬/এ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। শাহনাজ হোসেন দলের জন্য সাংঘাতিক পরিশ্রম করেছেন। ভবিষ্যতে আরও শ্রম দেবেন। তিনি প্রার্থী হতেই চান, তবে যদি একান্ত না পান, তাহলে তাঁর কোনো আক্ষেপ থাকবে না।
‘অমুকের আত্মীয়’
একটু বাদে দেখা হলো পটুয়াখালী-৩ আসনের বর্তমান সাংসদ আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইনের সঙ্গে। সাবেক বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী। গলাচিপা-দশমিনা সমুদ্রোপকূলীয় একটি সংসদীয় এলাকা। এলাকাটি এবারে বিশেষ আলোচনায় এসেছে। কারণ, এই আসনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে একটি নাম ইতিমধ্যেই ব্যাপকভাবে আলোচিত। তিনি হলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার ভাগনে এস এম শাহজাদা। বললাম, এবারে তো আন্তদলীয় প্রার্থী গিজ গিজ করছে। আপনার কী অবস্থা? আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন স্মিত হাসলেন। তাঁর কথায়, ‘উৎসবমুখর পরিবেশ’ ভাগ করে নিতেই তাঁর আসা। নিরেট রাজনৈতিক শ্লেষ বহুকাল কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। জাহাঙ্গীর সেটা ঈষৎ পুষিয়ে দিলেন। জানালেন, শরিকদের নিয়ে তাঁর আসনে টানাপোড়েন নেই। তাঁর কথায়, ‘আমার আসনে জমিনি বালা নেই। আসমানি বালা আছে।’ সেই বালাটা কে? জানতে চাইলে বলেন, ‘মিজান, আপনি তো মুশকিলে ফেলে দিলেন। তাঁর পরিচয়টাই হলো অমুকের আত্মীয়। (তাঁর) এ ছাড়া আর কোনো পরিচয় নেই। অনুমান করি, তিনি স্পষ্টতই ‘আসমানি বালা’ বলতে সিইসির ভাগনেকে বুঝিয়ে থাকবেন। কারণ, শাহজাদা কখনো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ছিলেন না। তাঁকে কখনো রাজনীতির উঠোনেই দেখা যায়নি। তিনি পটুয়াখালীর রাজনৈতিক আকাশে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়েছেন। সিইসির নিরপেক্ষতা প্রমাণ করা যেখানে জ্বলন্ত চ্যালেঞ্জ, সেখানে কী করে এ রকম একটি নাম নাজিল হতে পারে, সেটা ওই এলাকার অনেকেরই প্রশ্ন।
দশমিনার একজন শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ১৯টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এবং সংশ্লিষ্ট থানাগুলোর সভাপতি-সম্পাদকেরা লিখিতভাবে তিনজনকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। জাহাঙ্গীর হোসাইন তাঁদের অন্যতম। কিন্তু সেই তালিকায় ভাগনের নাম নেই। জাহাঙ্গীর হোসাইন স্পষ্ট ইঙ্গিত দেন, এর আগে ঠিক এই আসনেই একজন আগন্তুককে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি। সেই সাংসদ নানা কাণ্ড করে দল ত্যাগ করেছিলেন। তবে খোঁজখবর নিয়ে যা বুঝতে পারি, শুধু ভাগনে—এই জোরে যদি এবারে তাঁর তকদির খোলে, তাহলে ‘আসমানি বালা’-র প্রভাব গোটা দেশে পড়বে। একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনকে অযথা নতুন বিতর্কের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হবে কি না, সেটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
নায়ক সোহেল রানা
শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে রাত প্রায় নয়টা অবধি আওয়ামী লীগ অফিস চত্বরে কাটালাম। মুজিব কোট পরিহিত ব্যক্তিদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। তাঁদের অন্যতম ছিলেন তালুকদার মো. ইউনুস। বরিশাল-২ আসন হলো বানারীপাড়া ও উজিরপুর নিয়ে গঠিত। আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংসদ তিনি। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়েছিলেন গৌরনদী-আগৈলঝাড়া থেকে।
এবারে আওয়ামী লীগার এবং ১৪-দলীয় জোটের মিত্রদের মধ্যে একটা গুঞ্জন আছে। সেটা হলো মিত্রদের জন্য ছেড়ে দেওয়া অনধিক ৭০টি আসনে অবাধ নির্বাচন বা কম কারচুপিপূর্ণ হওয়ার একটি মনোভাব থাকতে পারে। এটা ঠিক হলে এসব আসন নিয়ে ইতিমধ্যে নানামুখী হিসাব-নিকাশ ও টানাপোড়েন দানা বাঁধতে শুরু হওয়ার কথা।
ইউনুসকে ঘিরে একটা জটলা এগিয়ে চলছিল। সেদিকে ইঙ্গিত করে আওয়ামী লীগের অফিসের সামনেই একজন সাংসদ আমাকে ইঙ্গিত করলেন। বললেন, ওনার কপালটাও পুড়তে পারে। তিনি জনপ্রিয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও জাতীয় পার্টির মাসুদ পারভেজ সোহেল রানাকে এই আসন ছাড়া হতে পারে বলে একটা আলোচনা আছে। বিএনপির প্রার্থী হওয়ার জন্য এখানে লড়াই করছেন শহিদুল হক জামালসহ অনেকেই। তালুকদার মো. ইউনুস জানালেন, তিনি আশাবাদী, কিন্তু দল যাঁকে দেবে, তাঁর জন্যই কাজ করতে প্রস্তুত।
শনিবার খোঁজ নিয়ে যা জানা গেল তা সত্য হলে ইউনুসের ফাড়া কাটবে। সোহেল রানা মনে করেন তিনি ছাত্রলীগ করেছেন প্রায় ৫০ বছর। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেট আজও তাকে ‘লিডার’ ডাকেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে জানেন। তার পৈতৃক নিবাস ওই আসনেও নয়, বাবুগঞ্জে। আড়াই শর বেশি ছবির নায়ক রানার জন্য আমাদের অবাক করেছেন। তিনি বলেছেন, বরিশাল–২ আসন বাদে বাংলাদেশের অন্য যেকোনো আসন থেকে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে প্রস্তুত। কিন্তু ওই আসনটি দিলেও তিনি নেবেন না। কেন নয়, এর উত্তর তিনি দেননি। তবে জানা গেছে, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলের বিষয়ে তিনি কিছু নেতিবাচক বিবৃতি দিয়েছিলেন। এখন তার আশঙ্কা, এখানে নির্বাচন করা তার জন্য ‘গিলোটিনে’ চড়া হবে। ভেতর থেকে তাঁকে হারানোর চেষ্টা চলবে।
নবীনের আবদার
দুই নবীনের তৎপরতা নজরে এল। দ্বীপজেলা ভোলার ছেলে হেমায়েত উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু পাবনা-২ আসনের এক ডজন মনোনয়নপ্রত্যাশীর মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ হলেন সম্রাট। তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর পক্ষে স্লোগানে ভাঙল ধানমন্ডির সান্ধ্য নীরবতা।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের নির্বাচনী এলাকার নবীন প্রতিদ্বন্দ্বী হেমায়েত উদ্দিন। তাঁর সঙ্গে কিছু লোককে দেখলাম। তিনি নাকি দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন কয়েক শ বা কয়েক হাজার লোক সঙ্গে নিয়ে। ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির একজন সদস্য। তিনি মূলত ঢাকায় থাকেন বলে জানা গেল। তবে মাঝেমধ্যে এলাকায় তাঁর পোস্টার দেখা যায়। তাঁর জনপ্রিয়তা কিংবা সামর্থ্য কতটা, তা এখনো পর্যন্ত যাচাই করা যায়নি। ফেসবুকে সক্রিয়। হেমায়েতের যুক্তি, ভোলায় গত ১০ বছরে ঢের উন্নয়ন হয়েছে; কিন্তু নবীন বিবেচনায় তিনি এবারে মনোনয়ন লাভের হকদার।
আগে দেখা যেত, নেতা ঢুকলেই স্লোগান উঠত, সেটা পাল্টেছে। পাবনা-২ আসনে এক তরুণ প্রার্থীর পক্ষে সেখানে থেমে থেমে স্লোগান উঠছিল। সেটাই ছিল ব্যতিক্রম। ‘সম্রাট ভাই এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে’। তাঁর পুরো নাম ইমরান সিরাজ, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া উপকমিটির সদস্য। সুজানগর ইউপির আওয়ামী চেয়ারম্যান তাঁর বাবা। এলাকায় তাঁর কিছুটা প্রভাব রয়েছে।
নজরে এল অলস ভঙ্গিতে বসে থাকা পুলিশের ভাবলেশহীন প্রহরা। পাশের দেয়ালে বিধি অনুযায়ী পোস্টার তুলে নেওয়ার দাগ। কিন্তু এসব দাগের মধ্যেও অন্তত একটি স্থানে সমবায় অধিদপ্তরের প্রকাশিত একটি রঙিন পোস্টার সহজেই চোখে পড়ে। আমি ভিডিও করছি দেখে কেউ একজন বললেন, ‘মিজান ভাই, আমরা কিন্তু পোস্টার অপসারণ করেছি।’
আয় বেড়ে চতুর্গুণ
হালকা ভিড় এড়িয়ে ডিটেক্ট-ফটক পেরিয়ে ভেতরে যাই। সেখানে একটি কক্ষে সবার অবাধ যাতায়াত নজরে এল। বারান্দায় রাখা কয়েক বান্ডিল পোস্টার। ২০০৬ সালের সঙ্গে ২০১৮ সালের উন্নয়নের তুলনা। মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ ডলার। এখন তা তিন গুণের বেশি—প্রায় ১ হাজার ৮০০ ডলার। রিকশাচালক ও দিনমজুরের আয় প্রায় চার গুণ বেড়েছে। দারিদ্র্যের হার সাড়ে ৪১ থেকে প্রায় ২০ শতাংশে নেমেছে। পোশাকশ্রমিকের মাসিক বেতন ১ হাজার ৬০০ টাকা থেকে আট হাজার টাকা হয়েছে। কিন্তু এই ‘খণ্ডচিত্রের’ তথ্যগুলোর উৎস কী, তা নির্দিষ্ট করা হয়নি।
ভেতরে তখন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নেতারা কথা বলছিলেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলেন।
কুশলবিনিময় হলো অসীম কুমার উকিলের সঙ্গে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, এমন কিছুই নয়, আলোচনা যা হয়েছে, তা নিতান্ত রুটিন। এর বাইরে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
বিরুদ্ধ পোস্টার নজরে পড়ল মাত্র একটি। এফবিসিসিআইয়ের একজন সাবেক সভাপতি অতীতে বিএনপির সঙ্গে আঁতাত ছিল—এই অভিযোগ এনে তাঁকে মুরাদনগর তথা আওয়ামী লীগ থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণার দাবি জানানো হয়েছে।
সেখানে অনেক হকারের সমাগম ঘটেছে। বেশির ভাগ চা-সিগারেট বিক্রেতা। তাঁদেরই একজন কবির হোসেন। এক সপ্তাহের ধরে এখানে নিয়মিত আসছেন তিনি। তাঁর প্রতিদিনের আয় দুই থেকে তিন হাজার টাকা। আগেও প্রায় সমপরিমাণ টাকাই আয় করতেন। কিন্তু সে জন্য তাঁকে অনেক পথ হেঁটে বেড়াতে হতো। এখন তিনি বিকেলে, কুয়াশা পড়তে শুরুর আগেই আওয়ামী লীগ অফিস লাগোয়া দালান ‘দখিন হাওয়া’র সামনে বসেন।