'চুক্তি হলে পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকত'

বাঁধের কারণে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির গজলডোবা বাঁধের এক পাশে পর্যাপ্ত পানি, অন্য পাশে চরের মাঝে সামান্য পানি। গুগল ম্যাপেও একই দৃশ্য দেখা গেছে
বাঁধের কারণে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির গজলডোবা বাঁধের এক পাশে পর্যাপ্ত পানি, অন্য পাশে চরের মাঝে সামান্য পানি। গুগল ম্যাপেও একই দৃশ্য দেখা গেছে
প্রায় তিন দশক ধরে আলোচনা করেও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সই করতে পারেনি বাংলাদেশ। অথচ অভিন্ন নদীটি নিয়ে চুক্তি হলে পানি পাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রাপ্যতা নিশ্চিত হতো। সেই পানির ওপর নির্ভর করে পর্যাপ্ত পরিমাণ জমি সেচের আওতায় আনা যেত। তিস্তার অভিজ্ঞতায় আলাদা আলাদা করে প্রতিটি নদীর পানি ভাগাভাগির চেয়ে অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনাকে কার্যকর মনে করছেন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রাহীদ এজাজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এই অভিমত দিয়েছেন

প্রথম আলো: ঠিক কখন থেকে ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ আলোচনা শুরু করে?

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে, বিশেষ করে তিস্তা প্রকল্পটি হওয়ার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে নদীটার পানির ভাগাভাগি নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করি। মূলত দুটি লক্ষ্যকে বিবেচনায় নিয়ে আমরা তিস্তা সেচ প্রকল্পটি করেছিলাম। এর একটি হচ্ছে সম্পূরক সেচ দেওয়া, অন্যটি হচ্ছে পুরোপুরি শুকনো মৌসুমের পানির সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা। কারণ সেই সময় ওই জায়গায় সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পানির কোনো অভাব ছিল না, সেই পানি ব্যবহার করে প্রায় পাঁচ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া ছিল তিস্তা প্রকল্প করার অন্যতম লক্ষ্য। অন্য কারণটা হচ্ছে শুকনো মৌসুমে, যখন পানির প্রবাহ কমে যায় তখন যে পানি পাওয়া যায়, তা দিয়ে ওই সময় সেচের ব্যবস্থা করা।
প্রথম আলো: পাঁচ লাখ হেক্টর জমিকে সেচের আওতায় আনার লক্ষ্য কি পূরণ হয়েছে?
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: না, তা পারিনি। এখন আমরা সোয়া এক লাখ থেকে দেড় লাখ হেক্টর জমিতে সেচের ব্যবস্থা করতে পারছি। কারণ দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে যেসব খাল করার কথা, তা আমরা সেখানে করতে পারিনি। এখন আমরা প্রকল্পের একটি সম্প্রসারণের কাজ করছি। এটি হলে আমরা আরও ২৫ থেকে ৩০ হাজার হেক্টর জমিকে সেচের আওতায় আনতে পারব। প্রকল্পের পুরো সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার করতে পারলে আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো হতো। বিশেষ করে সম্পূরক সেচের মৌসুমে।

প্রথম আলো: সেটা করা যাচ্ছে না কেন?

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে যেসব খাল দরকার ছিল আমরা তা করিনি। এ জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার ছিল (এর মধ্যে আছে জমি অধিগ্রহণ করে লোকজনের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা ইত্যাদি) খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগ হয়নি। সম্পূরক সেচের মৌসুমে কিন্তু পর্যাপ্ত পানি আছে।

প্রথম আলো: আপনি বলতে চাইছেন, বিনিয়োগের অভাবে তিস্তা প্রকল্পে সেচের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: কিন্তু আমাদের এখনকার যে অবকাঠামো আছে তা দিয়ে ভারতের কাছ থেকে যে পানি পেতে চাই তা কাজে লাগানোর জন্য যথেষ্ট। আমরা ভারতকে বলেছি, তিস্তার ২০ ভাগ পানি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য রেখে বাকি ৮০ ভাগ দুই দেশের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ হবে।

প্রথম আলো: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখেছি তিস্তার পানি কমে যাচ্ছে।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: গত দুই–তিন বছরে দেখা গেছে, তিস্তার পানি প্রায় শুকিয়ে গেছে। প্রতিবছর এই সময়টাতে যেখানে আমরা ১৫০০ থেকে ২০০০ কিউসেক পেতাম, তা গত তিন বছরে দিনে ৩৭০ কিউসেকে নেমে এসেছে।

প্রথম আলো: শুকনো মৌসুমে গত ১০ বছরের পানি পাওয়ার হারটা কেমন?

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: পানির প্রবাহ কিন্তু কমছেই। হঠাৎ করে খুব বেশি মাত্রায় কমে গেল ২০১৫-তে।

প্রথম আলো: এভাবে হঠাৎ করে ব্যাপক হারে পানি কমে যাওয়ার বিষয়টি কি ভারতের কাছে তুলেছেন?

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: তুলেছি।

প্রথম আলো: এ নিয়ে ভারতের ব্যাখ্যা কী?

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: এ নিয়ে তাদের সঙ্গে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। সিকিমে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ার একটা কথা তারা বলেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, বিশেষ করে বৃষ্টিপাতের প্রবণতায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের একটা প্রবণতা চোখে পড়ছে, এবার যেমন অতিবৃষ্টি হয়েছে। গত বছর এ ধরনের অতিবৃষ্টি হয়েছিল। ফলে এবারের মতো গত বছরও হাওরে ফসলডুবি হয়েছিল। তবে জলবায়ু কিংবা বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে যেকোনো পরিবর্তনই আসুক না কেন, তিস্তা চুক্তি হলে পানি পাওয়ার একটা নিশ্চয়তা থাকত। কৃষকেরাও আগে থেকেই জানতে পারতেন শুকনো মৌসুমে তাঁরা কতটা পানি পাচ্ছেন, আর সেই পানি দিয়ে কী পরিমাণ জমিতে সেচ দেওয়া যাবে। আমরা আমাদের মতো করে প্রস্তুতি নিতে পারতাম।

প্রথম আলো: তার মানে চুক্তি থাকলে পানি পাওয়ার একটা নিশ্চয়তা পাওয়া যেত।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: তা তো বটেই। চুক্তি পানির ভাগাভাগির ক্ষেত্রে সুরক্ষা দিত। চুক্তি না থাকাতে যে পানিটা পাচ্ছি সেটাও ঠিকভাবে কৃষকদের দিতে পারছি না।

প্রথম আলো: জলবায়ু পরিবর্তন, বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া ইত্যাদি নানা কারণে তিস্তায় প্রবাহ কমে যাওয়ার কথা বললেন। কিন্তু সম্প্রতি সিকিম সফরের সময় আমার এক সহকর্মীর অভিজ্ঞতা কিন্তু বলছে অন্য কথা। তিস্তায় যথেষ্ট পানি আছে।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: তিস্তায় পানি নেই, সেটা তো কেউ বলছে না। উজানে তিস্তা থেকে পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে, সেটা কিন্তু সত্যি।

প্রথম আলো: পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু বারবারই তিস্তায় পানি কমে যাওয়ার প্রসঙ্গটি সামনে নিয়ে আসছেন।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: পশ্চিমবঙ্গ বলছে সিকিম থেকে পানি কম আসছে। সিকিমের অবকাঠামো তৈরির কারণে পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। আমরা বলছি গজলডোবায় যে পানি আসে, তার ৫০ ভাগ আমাদের দেওয়া হোক। সেটাই পশ্চিমবঙ্গ দিতে রাজি নয়। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের তিস্তার পানি দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। বিশেষ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারকার দিল্লি সফরে একটা কথা স্পষ্ট করেই বলেছেন, যেটা এর আগে ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রী বলেননি। নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, তাঁর ও শেখ হাসিনার মেয়াদকালেই এই চুক্তিটা হবে। এ কথা বলে তিনি চুক্তি সইয়ের জন্য নির্দিষ্ট একটি সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। অর্থাৎ ২০১৮ সালের মধ্যে চুক্তি হবে। প্রথমবারের মতো তিস্তা চুক্তি সইয়ের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমার কথা বলা হলো।

প্রথম আলো: সময়সীমা ঘোষণাকে আপনি এবারের সফরের অগ্রগতি বলছেন। কিন্তু ভারত তার সরকার পরিচালনার পদ্ধতি অনুযায়ী রাজ্যকে সঙ্গে না নিয়ে কোনো দেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি না করার বিষয়টি তো এবারও বলেছে।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: এটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নিজস্ব বিষয়। সুতরাং বিষয়টি নিয়ে চিন্তার কোনো প্রয়োজন আমি দেখি না। আমাদের আলোচনা, যোগাযোগ সবটাই কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে।

প্রথম আলো: দুই সরকারই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিজেদের সম্পর্কে বেশ সন্তুষ্টির কথা বলে আসছে। এমন একটি সহায়ক পরিবেশে এসেও তিস্তা নিয়ে এত সময় লেগে যাচ্ছে কেন?

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: পানিবণ্টন নিয়ে যেকোনো আলোচনায়ই কিন্তু যথেষ্ট সময় লাগে। এটা আমাদের সঙ্গে হচ্ছে বলেই নয়। ভারতের প্রদেশগুলোতে কিন্তু পানি ভাগাভাগি নিয়ে দাঙ্গা ঘটতে দেখেছি। কিন্তু সমাধান হয়নি। পানির মতো গুরুত্বপূর্ণ উৎসের আলোচনাগুলো সব সময় জটিল ও সময়সাপেক্ষ।

প্রথম আলো: পানি নিয়ে আলোচনা জটিল এবং সময়সাপেক্ষ বললেন। এই যুক্তি মেনে নিলে দুই দেশের অভিন্ন নদীগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে অর্থাৎ অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনায় নিয়ে কি আমাদের কোনো পরিকল্পনা আছে?

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: আশির দশকে পানিসম্পদমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় এ নিয়ে আমার একটা প্রস্তাব ছিল। তখন বলেছিলাম তিনটা বড় নদী গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বাদ দিয়ে অন্য সব নদীর ক্ষেত্রে দুই দেশ অর্ধেক করে পানি নেবে। অর্থাৎ নদীর পানির ২০ ভাগ স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য রেখে বাকি ৮০ ভাগ সমান ভাগে নেবে দুই দেশ। এই ধরনের কোনো প্রস্তাবে নীতিগত সিদ্ধান্ত হলে তারপর নদীর পানি মাপজোখের বিষয়টি আসবে। পানি ভাগাভাগির সঙ্গে কিন্তু এর সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের বিষয়টিও জড়িত। আমরা যদি একটা নদীর ভাগাভাগি করি, হয়তো সেই নদীর সদ্ব্যবহার হবে, সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নয়। এ জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতা লাগবে। তাই আমাদের অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা লাগবে। পানি সমস্যার সমাধানে আমাদের এই অঞ্চলে অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় নজর দিতে হবে।

প্রথম আলো: অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সমীক্ষা, গবেষণার কোনো পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি কি আমরা নিয়েছি?

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: এটা করতে হলে তো আমাদের সবাইকে মিলেই করতে হবে। অববাহিকার সাত ভাগ এলাকা বাংলাদেশের, বাকি ৯৩ ভাগ কিন্তু বাংলাদেশের বাইরের। কাজেই পানি নিয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনা, গবেষণা তাদের ছাড়া করা সম্ভব না।

প্রথম আলো: এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক কিংবা অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে কি কথাবার্তা হচ্ছে?

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: যেমন এখন নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত উপ-আঞ্চলিক কাঠামোতে আলোচনা করছে। এই উদ্যোগে বিদ্যুৎ নিয়ে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। এরপর নদী ও পানি নিয়ে সহযোগিতায় অগ্রগতি আশা করছি।

প্রথম আলো: ভারত যেমন তিস্তার পানি প্রত্যাহার করছে, তেমনি বাংলাদেশও পানি প্রত্যাহার করছে বলে অভিযোগ করে থাকে কুড়িগ্রামের লোকজন। তাদের অভিযোগ, তিস্তা প্রকল্পের সুফল থেকে তারা বঞ্চিত।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: তিস্তা প্রকল্পে কুড়িগ্রামকে রাখা হয়নি। কুড়িগ্রামের জন্য ধরলা, দুধকুমারের মতো নদীগুলো থাকায় এই জেলাকে তিস্তা প্রকল্পে রাখা হয়নি। কাজেই কুড়িগ্রামের লোকজনকে না দিয়ে তিস্তার পানি নীলফামারীতে দেওয়ার অভিযোগ ঠিক না।

প্রথম আলো: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।