>• অগ্নিকাণ্ডের পর সোহরাওয়ার্দী থেকে ঢাকা মেডিকেলে ৩৮৫ জন রোগীকে নেওয়া হয়
• মুগদা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয় ৮ রোগীকে
• ট্রমার কারণে রোগীদের সুস্থ হতে সময় লাগবে
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুই মাস ধরে চিকিৎসাধীন ছিলেন মোসাম্মাৎ মানসুরা। অন্যের সহায়তা ছাড়া হাঁটতে পারেন না তিনি। গত বৃহস্পতিবার রাতে হাসপাতালে আগুন লাগার পর স্বজনেরা কোনোরকমে তাঁকে বাইরে বের করে আনেন। পরে তাঁকে নেওয়া হয় মুগদা জেনারেল হাসপাতালে। স্বজনেরা বলছেন, আগুন লাগার কথা মনে হলেই ভয়ে কেঁপে উঠছেন তিনি। চিকিৎসকেরা বলছেন, এই আতঙ্ক কাটিয়ে সুস্থ হতে রোগীর দীর্ঘ সময় লাগতে পারে।
মানসুরার স্বামী জাবেদ সরদার জানান, ‘আগুনের সময় দৌড়াদৌড়িতে কোনো কিছু নিয়ে বের হতে পারিনি। কোনোমতে জানটা নিয়ে বের হইছি। তবে সোহরাওয়ার্দী থেকে মুগদা হাসপাতালে আসতে অ্যাম্বুলেন্সে কোনো টাকা দেওয়া লাগেনি। এখানকার ডাক্তার ও নার্সরা আমার স্ত্রীর চিকিৎসা দিচ্ছে। যদি এই হাসপাতালেই সব চিকিৎসা হয়, তাইলে আর ওই হাসপাতালে ফেরত যামু না। আর যদি ডাক্তাররা যাইতে কয়, তাইলে তো যাইতে হবেই।’
আগুন লাগার পর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ৮ জন রোগীকে স্থানান্তর করা হয়। তঁাদের মধে্য গতকাল দুপুর পর্যন্ত দুজন সোহরাওয়ার্দীতে ফিরে গেছেন।
এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় রোগী ও রোগী আত্মীয়দের একটা বাড়তি মানসিক চাপ বা ট্রমা হতে পারে বলে জানান জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, হাজারখানেক মানুষকে দ্রুত সময়ের মধ্যে স্থানান্তর করা হয়েছে। আগুনের ঘটনা বড় হলেও বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কথা রোগীদের বলতে হবে। তাতে তাঁরা দ্রুত সময়ের মধ্যে ট্রমা কাটিয়ে উঠবেন। এটা নিরাময়ের জন্য রোগীর আত্মীয়স্বজনকে সতর্ক ও গণমাধ্যমগুলোকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। রোগীকে যেন কোনোভাবে ওই ঘটনার বীভৎস বর্ণনা স্মরণ করানো না হয়।
গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের একজন আঘাতপ্রাপ্ত আহত রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দ্রুত তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। পরে রোগীর আত্মীয়রা তাঁকে অন্যত্র নিয়ে যান।
ঢাকা মেডিকেলে ঠাঁই হয় ৩৮৫ রোগীর
অগ্নিকাণ্ডের ওই রাতে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) স্থানান্তর করা হয়েছিল ৩৮৫ জন রোগীকে। তাঁদের অনেকের জায়গা হয় হাসপাতালের দুই নম্বর ভবনের নিচতলার মেঝেতে। গতকাল শুক্রবার সকালে দেখা যায়, ১৫ জন রোগী মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে আছেন। রোগীর সঙ্গে আসা রাত জাগা স্বজনেরাও ঘুমাচ্ছিলেন একই বিছানায়।
জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেনের প্রয়োজন এমন রোগীদের ঠাঁই হয় হাসপাতালের ইমারজেন্সি অবজারভেশন (জরুরি পর্যবেক্ষণ) কক্ষে। সেখানে থাকা রোগীদের পাশে বসা স্বজনদের চোখেমুখে ছিল আগের রাতের আতঙ্ক আর ক্লান্তি। মুহূর্তের মধ্যে এত বড় ঘটনা কীভাবে সামাল দিলেন, সেটি ভেবে নিজেই অবাক হচ্ছিলেন নারায়ণগঞ্জের মো. সেলিম। ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত ষাট বছর বয়সী চাচাকে হাসপাতালের বিছানায় রেখে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাইরে গিয়েছিলেন ওষুধ কিনতে। মানুষের মুখে শুনতে পান হাসপাতালে আগুন লেগেছে। সেলিম বলেন, ‘এ কথা শোনার পরই দৌড়ে হাসপাতালে এসে দেখি পুরো হাসপাতালে ধোঁয়া আর অন্ধকার। মোবাইলের আলো দিয়ে চাচার অক্সিজেন মাস্ক খুলে হুইলচেয়ারে করে বাইরে নিয়ে আসি। অবস্থা দেখে আমার ছোট বোন জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।’
একই রকম আতঙ্কের সম্মুখীন হন যশোর থেকে আসা রোকাইয়া আক্তার। ব্রেইন স্ট্রোকের রোগী শাশুড়ির সঙ্গে হাসপাতালের নিচতলার ওয়ার্ডে ছিলেন তিনি। তিনি একাই শাশুড়িকে ট্রলিতে করে বাইরে আনেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৮০১ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কক্ষে বসে রোকাইয়া বলছিলেন, ‘একে তো রোগীর জীবন সংকটে, এর মাঝে হাসপাতালে আগুন লাগায় নিজের জীবন নিয়েই শঙ্কায় পড়ে যাই। আশপাশের মানুষ এগিয়ে না আসলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হতো না।’
ঢামেক সূত্র বলছে, সোহরাওয়ার্দী থেকে এই হাসপাতালে আসা ৩৮৫ জন রোগীর মধ্যে গতকাল দুপুরে ছিলেন ১২০ জন। তাঁদের মধ্যে ৪০ জন নারী, ৭৪ জন পুরুষ ও ৬ শিশু। এই রোগীদের মধ্যে অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় দুজনকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। বেলা ১১টার দিকে ঢামেক কর্তৃপক্ষ রোগী ও তাঁদের স্বজনদের সকালের খাবার দেয়। দুপুর নাগাদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল চালু হলে কিছু রোগী সেখানে ফিরে যান। বাকিদের স্থানান্তর করা হয় ঢামেকের বিভিন্ন ওয়ার্ডে।
হাসপাতালের উপপরিচালক বিদ্যুৎ কান্তি পাল জানান, সোহরাওয়ার্দী থেকে যারা এসেছে, তাদের বেশির ভাগই শ্বাসকষ্ট, হৃদ্রোগ ও ফুসফুসের ক্যানসারের রোগী।