বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির খোঁজে 'কল-রেডী'তে

‘কল–রেডী’ মাইকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই পৃথিবীবিখ্যাত ভাষণ। ছবি: সংগৃহীত
‘কল–রেডী’ মাইকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই পৃথিবীবিখ্যাত ভাষণ। ছবি: সংগৃহীত

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম...।’ বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই পৃথিবীবিখ্যাত ভাষণ। কোটি কোটি মানুষকে জাগ্রত করে স্বাধীনতার স্বপ্ন সত্যি করার প্রেরণা দিয়েছিল যে ভাষণ, আমরা যা এখনো ধারণ করে চলেছি আমাদের প্রাণে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছোট একটি নাম ‘কল–রেডী’।

বঙ্গবন্ধুর প্রায় সব কটি ঐতিহাসিক ভাষণের সাউন্ড সিস্টেম ব্যবস্থাপনায় ‘কল–রেডী’। বর্তমানে তারা এলাকার মিলাদ মাহফিল থেকে শুরু করে বঙ্গভবন ও গণভবনে অনেক অনুষ্ঠানের সাউন্ড সিস্টেম সরবরাহের দায়িত্বও পালন করে আসছে।

‘কল-রেডী’ নামটি বাংলার ইতিহাসের সাক্ষী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সভা-সমাবেশেও কল-রেডীর মাইকে বক্তব্য দিয়েছেন রাজনৈতিক নেতারা।

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ কল-রেডীর মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এ ছাড়া কল-রেডী মাইকে বক্তব্য দিয়েছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ অনেকে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিদেশের নেতাদের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি কল-রেডী মাইক্রোফোনে ভাষণ দেন।

‘কল–রেডী’র সাউন্ড সিস্টেমের কিছু অংশ। ছবি: লেখক

পুরান ঢাকার ৩৬ ঋষিকেশ দাস লেনে রয়েছে কল-রেডীর আদি কার্যালয়। ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয় ১৯৪৮ সালে। পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে এর যাত্রা শুরু হয় হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ নামের দুই ভাইয়ের হাত ধরে। বর্তমানে এর দায়িত্বে আছেন বিশ্বনাথ ঘোষ, শিবনাথ ঘোষ, সাগর ঘোষ ও রানা ঘোষ। এই চার ভাই পারিবারিক ঐতিহ্যকে ধরে রেখে এখনো ‘কল রেডী’কে আঁকড়ে আছেন।

পুরান ঢাকার শোরুমে ঢুকতেই দেখা হলো বিশ্বনাথ ঘোষের সঙ্গে। তিনি বেশ সজ্জন ব্যক্তি। আমাদের অনেক কিছু দেখালেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মৃতিবিজড়িত কয়েকটি ছবিও দেখলাম দেয়ালে টাঙানো। বিশ্বনাথ ঘোষ বঙ্গবন্ধুকে নিজ চোখে দেখেননি। কিন্তু তাঁর অনেক গল্প শুনেছেন বাবা হরিপদ ঘোষের কাছে। বঙ্গবন্ধু হরিপদকে স্নেহ করে ‘পাগলা’ ডাকতেন। বিউটি বোর্ডিং কিংবা তার আশপাশে এলে তিনি হরিপদকে দেখে যেতেন। বিশ্বনাথবাবু আরও জানালেন, বঙ্গবন্ধু নাকি মাঝেমধ্যে আসতেন কলতাবাজারে ভোলা খানের বাসায়। সেখানে জমত তাঁদের আড্ডা। ছোট-বড় সবাইকে তিনি বন্ধুর মতো ভালোবাসতেন। খুব দ্রুত মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। সবাইকে একসঙ্গে দেখতে পছন্দ করতেন। খুব হাসিখুশি আর প্রাণোচ্ছল এই মানুষটিকে নাকি দেখলে বোঝাই যেত না অধিকার আদায়ের কথায় তাঁর কণ্ঠ বজ্রের মতো কঠোর হয়ে যেতে পারেন। খোকা নামের এই মানুষটির একডাকে মুহূর্তেই ছুটে আসত দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাজারো মানুষ।

‘কল–রেডী’র এই কার্যালয়ে দুদিন আগে ঘুরে এসেছি আমরা। সেখানে বিশ্বনাথ ঘোষের কাছে জানতে চাইলাম, কেমন লাগে যখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মাইকে ‘কল–রেডী’ নামটি দেখেন। উচ্ছ্বসিত মানুষটি বলেন, ‘এ এক ঐশ্বরিক দান...অনেক ভালো লাগে। শত কোটি টাকার মালিক হলেও এত ভালো লাগত না।’

‘কল–রেডী’র কার্যালয়ে বিশ্বনাথ ঘোষ। ছবি লেখক

১৯৪৮ সালে দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। ওই বছর বিক্রমপুরের শ্রীনগর থানার মঠবাড়িয়া গ্রামের দুই ভাই হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে ‘লাইট হাউস’ নামের একটি আলোকসজ্জার দোকান চালু করেন। আলোকসজ্জার পাশাপাশি গ্রামোফোনও ভাড়া দেওয়া হতো। সভা-সমাবেশ ও বিয়েশাদিতে গ্রামোফোন ভাড়া নিত লোকজন। এভাবে অল্প দিনেই দোকানটি পরিচিত হয়ে ওঠে। চাহিদা বাড়তে থাকায় পরে বিদেশ থেকে মাইকের ইউনিট কিনে আনেন দুই ভাই। তাতেও চাহিদা মেটানো যাচ্ছিল না। হরিপদ ঘোষ মাইক তৈরি করতে জানতেন। পরে যন্ত্রপাতি কিনে নিজেই কয়েকটি মাইক তৈরি শুরু করেন।

লাইট হাউস থেকে কল-রেডীর নামকরণের বিষয়ে হরিপদ ঘোষের ছেলে সাগর ঘোষ বলেন, মাইক ভাড়া দেওয়ার জন্য লাইট হাউসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সব সময়ই প্রস্তুত থাকতেন, যাতে কেউ ডাকলেই আমরা রেডি থাকি। এক কথায়, কল করলেই রেডি। পরে দয়াল ঘোষ নিজে থেকেই ‘কল-রেডী’ নামটি ঠিক করেন।