ঢাকায় ভারতীয় অভিনেত্রী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা নন্দিতা দাসের মুখোমুখি হয়েছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। দুজনের আলাপচারিতায় উন্মোচিত হয়েছে কেন উর্দু সাহিত্যিক সা’দত হাসান মান্টোর জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন নন্দিতা দাস, কেন মান্টোর লেখা ও তাঁর জীবন একালেও তাৎপর্যপূর্ণ। সে আলাপচারিতা নিয়েই এবারের আয়োজন।
নন্দিতা দাসের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৯৮ সালের জুলাইতে ভারতের রাজস্থানে মানবাধিকারবিষয়ক এক সম্মেলনে। প্রথম পরিচয়েই দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তখন তিনি মানবতাবাদী, আবার নারীবাদী হিসেবেও নিজের পরিচয় তুলে ধরেছিলেন। তবে তিনি বলেছিলেন, আদর্শের দিক থেকে তিনি একজন বামপন্থী। এখনো নন্দিতা দাসের একই অবস্থান। তবে এখন আরও একটু জোরালো হয়েছে। এবার খুব দুঃখ নিয়ে তিনি বললেন, ভারতের অবস্থা খুব খারাপ, যে দেশে আমি বেড়ে উঠেছি, কিন্তু এখন আমি এ দেশটাকে চিনতে পারি না।
নন্দিতা দাস, ভারতের চলচ্চিত্রজগতের এক বড় আলোচিত তারকা। অসাধারণ অভিনেত্রী হিসেবে স্বীকৃত, বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। প্রথম চলচ্চিত্র ফিরাক (২০০৮) পরিচালনা করেই সম্মানিত হয়েছেন দেশে-বিদেশে। ফিরাক সিনেমার পটভূমি ছিল গুজরাটের ভয়াবহ দাঙ্গা।
নন্দিতা দাস দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন মান্টো। এ বছরের ১৮ মে ফ্রান্সের কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানোর পর থেকে ভারত আর ভারতের বাইরে তাঁর মান্টো নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। সম্প্রতি ঢাকায় লিট ফেস্টিভ্যালে মান্টো প্রদর্শিত হয়েছে। মান্টো নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন।
আসলে এই ‘মান্টো’ কে? কেন তাঁকে নিয়ে এত আলোচনা। ‘মান্টো’ সা’দাত হাসান মান্টো (১৯১২-১৯৫৫) উর্দু ভাষার অসাধারণ এক লেখক। তিনি ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক, উদার ও প্রতিবাদী লেখক। মান্টো মাত্র ২১ বছর সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত থেকে ৪৩ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। এ সময়ের মধ্যে িতনি ২২টি ছোটগল্পের বই, একটি উপন্যাস, দুটি স্মৃতিকথা, তিনটি প্রবন্ধ গ্রন্থ, পাঁচটি রেডিও নাটক ও অনেক সিনেমার কাহিনি রচনা করেছেন। তিনি ছিলেন ভারতীয়, আবার পাকিস্তানেরও।
১৯৪৭ সালে দেশভাগ, ভারত ও পাকিস্তান দুই রাষ্ট্রের জন্ম, ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা এবং হাজারো–লাখো মানুষের করুণ মৃত্যুকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। তখন তিনি মুম্বাইয়ের সিনেমাজগতে কাজ করেন। সেখানেও হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা-বিরোধ দেখা দেয়। মান্টো চাকরিচ্যুত হন। সব হারিয়ে যাওয়ার বেদনা নিয়ে এক নিভৃত একক জীবনযাপন করতে শুরু করেন। তারপর মুম্বাই ছেড়ে জাহাজে করাচি হয়ে লাহোরে চলে আসেন ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে। সেখানে তাঁর স্ত্রী সুফিয়া আর তাঁর তিন মেয়ে আগে থেকেই ছিলেন।
লাহোরে সা’দাত হাসান মান্টো তেমন কোনো কাজ পাননি, আয়–রোজগার হয়নি, স্বীকৃতি বা সম্মানও পাননি। কঠিন আর্থিক অনটনের মধ্যে তাঁর জীবন চলেছে। পাকিস্তান সরকার তাঁকে কমিউনিস্ট মনে করত। নানা নিষেধাজ্ঞা ছিল তাঁর ওপর। আসলে সা’দাত হাসান মান্টো শেষ পর্যন্ত নতুন একটি মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের কথা ভেবেছেন। কিন্তু তাঁর সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
আসলে নন্দিতা দাস মান্টোর সেই জটিল-কঠিন এক সময়কাল এবং আজকের সময়কালের মধ্যে অনেক কিছুরই যেন গভীর মিল খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর লেখনীর ওপর বাধা এসেছে, ছয়বার তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। শাস্তি পেয়েছেন, আবার মুক্ত হয়েছেন। কিন্তু তিনি থেমে যাননি। এখনো মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশে প্রকট বাধা রয়েছে আমাদের মতো দেশগুলোতে। সে জন্যই মান্টো সিনেমার ভাষায় নন্দিতা দাস সমসাময়িক সময়ের গভীর সংকটগুলোর সমাধানের পথ খুঁজতে চেয়েছেন। সে জন্য নন্দিতা দাস এ সময়ের ‘মান্টো’দের জন্য, যাঁরা নিরাপদ নন, যাঁরা এখনো কথা বলে যাচ্ছেন, তাঁদের পাশে থাকতে চেয়েছেন। তাঁদের সাহস জোগাতে চেষ্টা করেছেন। সেখানে তিনি সফল হয়েছেন।
৯ নভেম্বর সকালে হোটেল সোনারগাঁওয়ের উন্মুক্ত রেস্তোরাঁয় নন্দিতা দাসের সঙ্গে কথা হয়। কথোপকথনের বিষয়গুলো সাক্ষাৎকার আকারে এখানে প্রকাশ করা হলো।
মতিউর রহমান: এমন একটা ইন্টারেস্টিং সময়ে আপনি এসেছেন, ৪ নভেম্বর ছিল আমাদের ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
নন্দিতা দাস: অভিনন্দন।
মতিউর রহমান: ওপাশে দেখুন, প্রস্তুতি চলছে। আজ সন্ধ্যায় আমরা এখানে একটা বড় অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছি। আমরা আপনাকে মিস করব।
নন্দিতা দাস: আমিও মিস করব।
মতিউর রহমান: নন্দিতা দাস, আপনার সিনেমা ফিরাক আমি দেখেছিলাম কলকাতায়।
নন্দিতা দাস: ও, ১০ বছর আগে, ২০০৮ সালে।
মতিউর রহমান: গুজরাট দাঙ্গা ২০০২ সালে হয়েছিল, সেটা নিয়ে একটা দুর্দান্ত সিনেমা। আমার এত ভালো লেগেছিল!
নন্দিতা দাস: ফিরাক অনেক ফেস্টিভ্যালে গেছে। তবে মান্টো–এর যাত্রা তো কেবল শুরু হয়েছে। আমরা কানে শুরু করেছি।
মতিউর রহমান: আপনি যে এখন মান্টোটা করলেন, মান্টোর নাম আমরা জানি, আমরা জানি যে ভারতে, পাকিস্তানে উর্দু সাহিত্য, হিন্দি সাহিত্য খুব ভালো, খুব প্রগতিশীল...
নন্দিতা দাস: চল্লিশের দশকে একটা খুব প্রগতিশীল আন্দোলন ছিল।
মতিউর রহমান: আপনি যেটা বললেন, ভারতের প্রগ্রেসিভ রাইটার্স ইউনিয়ন, এটা আমাদের জন্য একটা বড় অনুপ্রেরণার বিষয়, দারুণ কাজ করত তারা।
নন্দিতা দাস: বহু লেখক ছিল—হিন্দি, উর্দু, ইংলিশ...
মতিউর রহমান: সা’দাত হাসান মান্টো তার মধ্যে ছিলেন, তাঁর বন্ধুরা সবাই ছিলেন, যত দূর জানি আপনার সিনেমাটা কান উৎসবে গেল, তা আপনি হঠাৎ মান্টোতে গেলেন কেন?
নন্দিতা দাস: সবাই এটাই জিজ্ঞেস করে, কেন মান্টো, তো মান্টো কেন? আমি ২০১২ সালে ওনাকে পুনরাবিষ্কার করলাম। আমি কলেজে পড়েছিলাম ছোটগল্পগুলো, কিন্তু ২০১২ সালে যখন আমি ওনার প্রবন্ধগুলো পড়লাম আর ওনার শতবার্ষিকী উৎসবে অনেক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব তাঁর সম্পর্কে লিখলেন, আমি সেগুলো পড়লাম এবং ভাবলাম, মাই গড, উনি এত সমকালীন! মান্টো যেসব বিষয় নিয়ে লিখেছেন, যেগুলো সে সময়েরও সংকট ছিল, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে লিখেছেন, আপনি যে বলছিলেন, ধর্মীয় সংঘাত, জাতীয়তাবাদ নিয়ে—এসব নিয়ে উনি কথা বলছেন, এগুলো আজকের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। আমার চারপাশে যা কিছু ঘটছে, সেগুলোর ব্যাপারে আমরা সাড়া দিতে চাইছিলাম। তো ভাবলাম, এই ছবির মধ্য দিয়ে আমি সাড়া দিতে পারব। জানাতে পারব, আমাদের চারদিকে কী হচ্ছে, আমাদের দেশে, সারা পৃথিবীতে আমরা পরিচয় নিয়ে এত ঝগড়াঝাঁটি কেন করছি।
মতিউর রহমান: মান্টো তো দিল্লিতে ছিলেন, মুম্বাইতে ওনার বড় কাজের সময়, কিন্তু ভারতবিভক্তির সময় দেশভাগ এবং হিন্দু–মুসলিম যে দাঙ্গা এটা ওনাকে গভীরভাবে ব্যথিত, দুঃখিত করেছে।
নন্দিতা দাস: হ্যাঁ, খুব ব্যক্তিগতভাবে দাগ কেটেছে।
মতিউর রহমান: দু–একটি ঘটনাও আমরা জেনেছি। অভিনেতা শ্যাম, যিনি তাঁর বন্ধু ছিলেন, তিনি তাঁকে মেরে ফেলতে পারেন, এ কথাটা বন্ধু শ্যাম বলেছিলেন।
নন্দিতা দাস: হ্যাঁ, এতে ওনার খুব আঘাত লেগেছিল।
মতিউর রহমান: তারপরে তিনি যে স্টুডিওতে কাজ করতেন, বম্বে টকিজ এবং ফিল্মিস্তান, সেখান থেকে তাঁকে বের করে দেওয়ার চিঠি দেওয়া হলো, অশোক কুমারের মতো মানুষ তাঁকে খুব একটা সাহায্য করলেন না, এতে খুব গভীর দুঃখ–ব্যথা উনি পেয়েছিলেন।
নন্দিতা দাস: হ্যাঁ, উনি কিছু লিখতে পারলেন না।
মতিউর রহমান: এই যে দাঙ্গা, এই যে দেশ বিভাগ, তার মধ্যে মান্টো কিন্তু আর উঠে দাঁড়াতে পারলেন না। উনি পাকিস্তানে চলে গেলেন ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে, লাহোরে গেলেন, উনি লেখালেখি করলেন, সবকিছু করলেন, কিন্তু আর্থিক অনটন, খুব দুঃখ–ভারাক্রান্ত সময় তিনি কাটালেন।
নন্দিতা দাস: এই বিমর্ষতার জন্য মদ্যপানে আসক্তি তৈরি হয়ে গেল তাঁর।
মতিউর রহমান: আমি দেখলাম যে উনি লেখক ইসমত চুঘতাইকে বলেছিলেন যে মুম্বাই ফিরে যেতে চান আবার, সেটাও হলো না।
নন্দিতা দাস: সেটাও হলো না, আর ওনার ইগোও ছিল একটু। এত অভিমানী ছিলেন যে ওনার একেবারে লেগে গেল।
মতিউর রহমান: ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০—আপনার সিনেমায় এই সময়কালটা আপনি ধরেছেন। কিন্তু এর পরেরটুকু, তার সবচেয়ে দুঃখ–কষ্টের সময়টুকু কেন আপনি নিলেন না বা নিতে চাইলেন না?
নন্দিতা দাস: আমি শুরু যখন করলাম চিত্রনাট্য লেখা, তখন ১০ বছরের গল্প ছিল—১৯৪২ থেকে ১৯৫২ সাল। কিন্তু এত বিষয় ছিল, উনি এত লিখেছেন, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, সবকিছু—যে একটা ছয় ঘণ্টার ছবি হয়ে যেত। সে জন্য ওটা কেটে কেটে অবশেষে ভাবলাম, ওনার জীবনে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ যে বছরগুলো, ওনার জীবনে এবং ভারত ও পাকিস্তানের জীবনেও ওই ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৫০ সাল ছিল। মানে দেশভাগের আগে এবং দেশভাগের পরে। আপনি তো জানেন, দেশভাগই পুরো উপমহাদেশের আদল গড়ে দিয়েছে, নানান দিক থেকে। যে রকম আপনাদের দেশের ক্ষেত্রে একাত্তর।
একাত্তরের আগে ও পরে নিশ্চয়ই একটা স্পষ্ট বিভক্তি আছে। তো সেই সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে জন্যই ছোট করে করেছি। বহু লোক মান্টোকে চেনে না। ফলে আমাকে দর্শকের কথাও ভাবতে হয়েছে। দেশভাগের কারণে তিনি যে সংকটের মধ্য দিয়ে গেছেন। উনি বম্বে ভালোবাসতেন। বলতেন, ‘মেয় চালতা–ফিরতা বম্বাই হু’—আই অ্যাম অ্যান ওয়াকিং–টকিং বম্বে। সে শহর ছেড়ে কেন উনি লাহোর গেলেন, আর তারপর কেন ফিরে এলেন না, কীভাবে সমাজ এ ধরনের লোকগুলোকে ধ্বংস করে দিতে শুরু করে, এগুলো বোঝার চেষ্টা করেছি। আমাদের তো একটা কর্তব্য আছে। আমরা সবাই আত্মতুষ্ট। এ যুগের মান্টোরা, যাঁরা কোনোরকম নিষেধ না শুনে আমাদের সবার জন্য কথা বলে যাচ্ছেন, তাঁরা কেউ নিরাপদ নন।
মতিউর রহমান: আমি দেখলাম মান্টোর ২২টা ছোটগল্পের বই আছে, উপন্যাস আছে, স্মৃতিচারণা আছে, সিনেমার স্ক্রিপ্ট, কত কিছু আছে। এখন ইংরেজিতে অনুবাদ হয়ে শুধু ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান নয়, বিশ্বব্যাপী তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠছেন।
নন্দিতা দাস: হ্যাঁ, কত ভাষায় ওনার অনুবাদ হয়েছে। আমি ফ্রান্সে পেলাম, জাপানে আছে। আর সব প্রকাশনী আমাকে বলছে, এই ছবির পর থেকে তাঁর বইয়ের পাঠক বেড়ে গেছে, তাঁর বই বেশি বিক্রি হচ্ছে।
মতিউর রহমান: আমাদের যে প্রকাশনা আছে বাংলাদেশে, তার থেকে আমরা মান্টোর একটা বই করেছি। আরেকটা ছোট বই এক মাসের মধ্যে বের করব। এরপর ছোটগল্পের একটা বড় সংকলন করার পরিকল্পনা আছে আমাদের।
নন্দিতা দাস: বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মান্টো পড়া উচিত।
মতিউর রহমান: আপনার সিনেমাটাও কিন্তু নতুন করে শুধু ভারত–পাকিস্তান–বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী মান্টোকে সামনে নিয়ে এসেছে।
নন্দিতা দাস: হ্যাঁ, ওনাকে নতুন করে তুলে ধরেছে। দেখুন, আমরা শেকস্পিয়ার জানি, অস্কার ওয়াইল্ড জানি, হেমিংওয়ে জানি, পশ্চিমা সাহিত্য ও লেখকদের কত ভালোভাবে জানি। কিন্তু আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার লেখক–শিল্পীদের সম্পর্কে লোকে জানে না। যখন ওরা মান্টো দেখল, ধরুন সিডনিতে, বা কানে, টরন্টোতে, ওরা সবাই বলল, মাই গড, উনি এত আধুনিক মানুষ, উনি কি সত্যি সত্যি ভারত–পাকিস্তান, দক্ষিণ এশিয়ান ছিলেন?
মতিউর রহমান: আবার দেখুন, তাঁর কেমন একটা ইগো, ঔদ্ধত্য ছিল, এপিটাফে তিনি লিখেছেন যে কে সবচেয়ে ভালো গল্প লেখে, গড না আমি?
নন্দিতা দাস: মজা করে বলা, হা হা হা।
মতিউর রহমান: ফিরাক থেকে মান্টো। সামনে নতুন আর কোনো সিনেমা করার ইচ্ছা কি আপনার আছে?
নন্দিতা দাস: হ্যাঁ, সিনেমা তো নিশ্চয় করব। ফিরাক আর মান্টো—দুটোর ক্ষেত্রে কোনো চয়েস ছিল না। দুটোর ক্ষেত্রে আমার ভেতর থেকে একটা জোর তাগিদ এসেছে যে এই গল্পগুলো আমি বলতে চাই। এই প্রথমবার আমি বেছে নিতে বসেছি যে আমি পরবর্তী সময়ে কী করব। আমি ভাগ্যবান যে অনেক প্রজেক্ট পাচ্ছি।
মতিউর রহমান: এক দিকে অভিনয় করা, আরেক দিকে চলচ্চিত্র পরিচালনা করা, আরেক দিকে সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে আপনার কাজ করা—এগুলো কি পাশাপাশি চলতে থাকবে?
নন্দিতা দাস: হ্যাঁ, সেইটাই আমার মূল ইচ্ছা। চলচ্চিত্র আমার জন্য একটা লক্ষ্যপূরণের হাতিয়ার। খালি একজন অভিনেত্রী বা পরিচালক হওয়ার জন্য আমি করি না। আমি ভাবি যে এটা একটা মাধ্যমমাত্র। গল্প বলার মধ্য দিয়ে আমি আমার ভাবনাগুলো যদি ভাগাভাগি করে নিতে পারি বৃহত্তর দর্শকসমাজের সঙ্গে, সেটাই আমার চেষ্টা।
মতিউর রহমান: আপনার সঙ্গে আমার ২০০০ সালে দেখা, ২০১২ সালে দেখা, এবার আবার দেখা। এই সময়ের মধ্যে আপনি নিজেকে কীভাবে দেখেন?
নন্দিতা দাস: আমি কোনো দিন কোনো পরিকল্পনা করিনি বা নিজেকে পাঁচ বছর পর কোথায় দেখব, সেটাও ভাবিনি। জিনিসগুলো হবে এবং আমি সহজাত প্রবৃত্তির বশে সেগুলোতে সাড়া দেব। তবে চারপাশে যা ঘটছে, তা নিয়ে আমি ভাবি, আপনিও তা–ই করেন। আপনি খবরের কাগজ বের করছেন বা নানা রকম কর্মকাণ্ড করছেন। সে রকম আমিও নানা রকম জিনিস করি। যেমন আমি নানা রকম বক্তৃতা দিই বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে। এখন আমি বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এ কাজ করছি, যেমন হার্ভার্ড, এমআইটি। আপনার এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে তো ডাকছে না, কিন্তু বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ডাকছে।
মতিউর রহমান: ভালো হলো আপনি বলেছেন। আপনি ঢাকা লিট ফেস্টে এসেছেন। নারী বিষয়ে বলেছেন, ‘ডার্ক ইজ বিউটিফুল’ নামে একটি ক্যাম্পেইন আপনি করেন।
নন্দিতা দাস: ‘ডার্ক ইজ বিউটিফুল’ প্রসঙ্গে কেউ আমাকে বলল, ওটার অনুপ্রেরণায় এখানে নাকি ‘সুন্দর মানে ফর্সা না’ বলে একটা আন্দোলন হয়েছিল। আমি খুব খুশি হয়েছি।
মতিউর রহমান: আপনার বাবা যতীন দাসের আমি বিরাট ভক্ত, তাঁর চিত্রকলার ভক্ত।
নন্দিতা দাস: উনি এখনো এঁকে যাচ্ছেন। ওডিশায় একটি কলাকেন্দ্র তৈরির জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মতিউর রহমান: ওডিশার জাদুঘরের কথা জানি। আমি অনেক পাখা দিয়েছিলাম, আমাদের দেশীয় পাখা আমি দুবার নিয়ে গিয়েছিলাম।
নন্দিতা দাস: আট হাজার পাখা আছে সেখানে।
মতিউর রহমান: আমি অনেকগুলো দিয়েছি।
নন্দিতা দাস: বাংলাদেশের ভালো প্রতিনিধিত্ব হবে, যখন আমাদের পাখার জাদুঘর হবে।
মতিউর রহমান: শেষ কথা, গতকাল আপনি সেমিনারে বলেছেন, আমাদের কথা বলে যেতে হবে...
নন্দিতা দাস: হ্যাঁ, যত বাধা আসুক, যত নিষেধাজ্ঞা দিক, আমাদের ‘একলা চলো রে’ বলে যেতে হবে, যেমনটা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
মতিউর রহমান: নন্দিতা দাস, বাংলাদেশে আসার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
* ফেসবুকে প্রচারিত সাক্ষাৎকারটি এখানে ঈষৎ সংক্ষিপ্ত ও সংশোধন করা হয়েছে।