'আলোর ফেরিওয়ালা' পলান সরকার আর নেই

গ্রামে গ্রামে ঘুরে ছোট-বড় সবার দোরগোড়ায় বই হাতে পৌঁছে যেতেন পলান সরকার। সেই পলান সরকার আর বই বিলি করবেন না। আজ শুক্রবার দুপুরে ৯৮ বছর বয়সে নিজ বাড়িতে তিনি মারা যান (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ ছিলেন পলান সরকার।

এভাবেই বই বিলি করতেন পলান সরকার। ছবি: প্রথম আলো
এভাবেই বই বিলি করতেন পলান সরকার। ছবি: প্রথম আলো

নিজের টাকায় বই কিনে পাঠকের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বই পড়ার একটি আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য পলান সরকার ২০১১ সালে একুশে পদক পান। ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে নিয়ে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’তে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হয় ‘বিনি পয়সায় বই বিলাই’ শিরোনামে। এটিই তাঁকে নিয়ে প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রথম প্রতিবেদন।
পরে সরকারিভাবে পলান সরকারের বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার করে দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে বিশ্বের ভিন্ন ভাষার প্রধান প্রধান দৈনিকে একযোগে পলান সরকারের বই পড়ার এই আন্দোলনের গল্প ছাপা হয়। সারা দেশে তাঁকে বহু বার সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। তাঁকে নিয়ে ‘সায়াহ্নে সূর্যোদয়’ নামে একটি নাটক তৈরি হয়েছে।

বই নিয়ে গ্রামের পথে পলান সরকার। ছবি: প্রথম আলো

পলান সরকারের জন্ম ১৯২১ সালে। তাঁর আসল নাম হারেজ উদ্দিন। তবে পলান সরকার নামেই তাঁকে চেনে দশগ্রামের মানুষ। জন্মের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় তাঁর বাবা মারা যান। টাকাপয়সার টানাটানির কারণে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই লেখাপড়ায় ইতি টানতে হয় তাঁকে। তবে নিজের চেষ্টাতেই চালিয়ে যান পড়ালেখা। স্থানীয় একটি উচ্চবিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ছিলেন পলান সরকার। তিনি ছিলেন বই পাগল মানুষ। প্রতিবছর স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যারা ১ থেকে ১০-এর মধ্যে মেধা তালিকায় স্থান পাবে, তাদের তিনি একটি করে বই উপহার দিতেন। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর বই বিলির অভিযান। এরপরে তিনি সবাইকে বই দিতেন। ডাক্তারি পরীক্ষায় ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পর নিজেই হেঁটে হেঁটে বই বিলি করতেন। একটানা ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে করেছেন এই কাজ। রাজশাহী অঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রামজুড়ে তিনি গড়ে তুলেছেন বই পড়ার এক অভিনব আন্দোলন। প্রথম আলো তাই তাঁর নাম দেয় ‘আলোর ফেরিওয়ালা’।

মেয়ে রোকেয়া খাতুনের সঙ্গে আলোর ফেরিওয়ালা পলান সরকার। ছবি: প্রথম আলো

২০১৬ সালে পলান সরকারের মুখোমুখি হয়েছিল প্রথম আলো। তখন তাঁর বয়স ৯৬ বছর। তিনি জানান, বই বিতরণের জন্য এলাকাভিত্তিক পাঁচটি বিকল্প বই বিতরণ কেন্দ্র তৈরি করেছেন। এ জন্য কয়েকটি বাজারের বইপ্রেমী কোনো দোকানিকে বেছে নিয়েছেন তিনি। দোকানের মালিক দোকানে মালামালের পাশাপাশি পলান সরকারের বইও রাখেন। সেখান থেকে স্থানীয় লোকজন বই নিয়ে যান। পড়া বই তাঁরা নিজেরাই আবার ফেরত দিয়ে নেন নতুন বই। মাসে এক-দুবার করে পলান সরকার দূরবর্তী এই কেন্দ্রগুলোতে ছেলের সঙ্গে মোটরসাইকেলে চেপে গিয়ে নতুন বই দিয়ে পুরোনো বই নিয়ে আসেন। এ ছাড়া পাঠাগারে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। পুরস্কার হিসেবে তাদের হাতেও পলান সরকার বই তুলে দেন।

পলান সরকার যতদিন বেঁচেছিলেন ছড়িয়ে দিয়েছেন আলো। আজ সেই আলোর ফেরিওয়ালা চলে গেলেন।

আরও পড়ুন
আলোর ফেরিওয়ালা
এখনো তিনি বই বিলান
আলোর ফেরিওয়ালা
আমার বাবা পলান সরকার