৯ মাসের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির উদ্যোগ নিতে হবে

২৫ মার্চ শুক্রবার ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ উপলক্ষে বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তনে আয়োজিত সেমিনারে ৬ জেলার গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপের তথ্য নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়
ছবি: প্রথম আলো

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ এ দেশে পাকিস্তানি বাহিনীর সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার সুযোগ হারিয়েছে বাংলাদেশ। এখন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ৯ মাসের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। সে জন্য ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস পালন এবং এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার যে প্রস্তাব ২০১৭ সালে সংসদে পাস হয়েছিল, তাতে সংশোধন আনতে হবে। পাশাপাশি বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সহায়তা পেতে কূটনৈতিক পদক্ষেপ শুরু করতে হবে।  

আজ ২৫ মার্চ শুক্রবার ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ উপলক্ষে ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’ আয়োজিত এক সেমিনারে এ আহ্বান জানানো হয়। সেমিনারে জানানো হয়, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি, ৩৫-৩৬ লাখ হতে পারে। ওই সময় ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যাও ২ লাখের বেশি, ৫ লাখ পর্যন্ত হতে পারে।

বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশের গণহত্যার পাঁচ দশক ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি’ শিরোনামে সেমিনারটি হয়। সেমিনারে প্রবন্ধ পাঠ করেন গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি, কবি ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। অনুষ্ঠানে গণহত্যাবিষয়ক কবিতা পাঠ করেন গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি কবি তারিক সুজাত। বিশেষ অতিথি ছিলেন কবি আসাদ মান্নান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন গণহত্যা জাদুঘরের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।

মূল প্রবন্ধে গণহত্যার তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে যে গণহত্যা হয়েছে, তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে ব্যাপক ও পরিকল্পিত হত্যা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা ও ঢাকার বাইরে হত্যাকাণ্ডের খবর ২৭ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। খবরে বলা হয়েছিল, এক লাখ পর্যন্ত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ড বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন পরিচালিত চলমান গবেষণায় একাত্তরে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। ধর্ষণের শিকার ২ লাখ নারীর কথা সরকারি হিসাবে আছে। এ হিসাবটি এসেছে, যাঁরা সরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে এসে তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন আর রেডক্রসের সেবাগ্রহীতার তথ্য থেকে। ওই সময় রেডক্রস জানিয়েছিল, তারা দেড় লাখ নারীর গর্ভপাত করিয়েছিল। কিন্তু অনেক নারী গর্ভধারণ করেননি, আবার অনেকে সন্তান জন্ম দিয়ে দিয়েছিলেন। রেডক্রসের মতে, মোট হিসাবে এ সংখ্যা ৪ লাখের বেশি হতে পারে। এ ছাড়া অনেকে লোকলজ্জায় ধর্ষণের কথা চেপেও গিয়েছিলেন।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় শাহরিয়ার কবির বলেন, এর আগে দেশে ২৫ মার্চকে জাতীয় দিবস হিসেবে পালনের কোনো স্বীকৃতি না থাকায় ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব পাস করে। এই সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় এখন সরকারকে ৯ মাসের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। এর জন্য ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস পালন ও এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার যে প্রস্তাব সংসদে পাস হয়েছিল তাতে সংশোধন আনতে হবে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর যেসব দেশে গণহত্যা হয়েছে, তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে হবে। অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে এবং ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তিনি বলেন, গণহত্যাকারীরা দাপটের সঙ্গে এখনো রাজনীতি করছে। গণহত্যাকারী কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলেও সবার বিচার হয়নি।

নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার আহ্বান জানান কবি আসাদ মান্নান। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন আমাদের একমাত্র ক্ষতচিহ্ন হিসেবে সাহস জোগাবে নতুন প্রজন্মকে। বাংলাদেশ এখনো শত্রুমুক্ত নয়। বারবার আঘাত পাবে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। শত্রুদের বিরুদ্ধে গণহত্যার এই ঘটনাকে অস্ত্র করে দাঁড়াতে হবে। কোনো বিসর্জনই ব্যর্থ হবে না। তরুণ প্রজন্ম যেন মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করতে পারে, এ জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তকে গণহত্যার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, গণহত্যা জাদুঘর দেশব্যাপী যে গণহত্যা-নির্যাতন, বধ্যভূমি ও নির্যাতনকেন্দ্রের জরিপ কার্যক্রম চালাচ্ছে, তাতে বিস্ময়কর চিত্র উঠে আসছে। তিনি বলেন, রেফারেন্স বইয়ে গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবর ও নির্যাতন কেন্দ্রের সর্বোচ্চ সংখ্যা ছিল ৯০৫, আর চলমান জরিপে ৩৪টি জেলায় সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ২৮৬। তাহলে ৬৪ জেলার সে সংখ্যা কত দাঁড়াতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। একেকটি গণহত্যার ঘটনায় ৫ জন থেকে ১০ হাজার পর্যন্ত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, গণহত্যা নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধচর্চার ইতিহাস ও গণহত্যার মধ্যে ভারসাম্যহীনতা হয়েছে। কারণ, গণহত্যার কথা বলা হলেই কারা হত্যাকারী, সে তথ্য বেরিয়ে আসবে, এ কারণে অনেক তথ্য চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে আগে।

‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’ এ পর্যন্ত গণহত্যা বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ সিরিজে ৩৪টি বই প্রকাশ করেছে। অনুষ্ঠানে ৬টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়—রীতা ভৌমিকের ‘গণহত্যা বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ নরসিংদী জেলা’, মাহফুজুর রহমানের ‘গণহত্যা বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ সিরাজগঞ্জ জেলা’, আলী ছায়েদের ‘গণহত্যা বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ গাজীপুর জেলা’, আমিনুর রহমান সুলতানের ‘গণহত্যা বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ ময়মনসিংহ জেলা’, মামুন তরফদারের ‘গণহত্যা বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ টাঙ্গাইল জেলা’ এবং আরিফুল হক ও মাসুদ রানার ‘গণহত্যা বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ রাজবাড়ী জেলা’।