সাতক্ষীরা সদরে দশম শ্রেণির এক ছাত্রীর (১৫) বিয়ের দিন ছিল গতকাল শুক্রবার। তার কয়েকজন বান্ধবী গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাতক্ষীরায় প্রথম আলো কার্যালয়ে হাজির হয়ে বিষয়টি জানায়। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে বিষয়টি জানানো হয় জেলার বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি ও মেয়েটির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানকে। তাঁদের উদ্যোগে গতকাল বন্ধ হয় এই বাল্যবিবাহ।
এ ছাড়া গত তিন দিনে সাতক্ষীরাসহ ৯ জেলায় আরও ১১টি বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়েছে উপজেলা প্রশাসন এবং পুলিশের উদ্যোগে।
সাতক্ষীরায় গতকাল দশম শ্রেণির যে ছাত্রীর বিয়ের দিন ধার্য ছিল, তার বাড়ি সদর উপজেলায়। কামালনগরের এক যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করেছিল পরিবার। বিয়েতে তার মত ছিল না। জেলার বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির প্রশাসনিক প্রধান সাকিবুর রহমান বলেন, সদরের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দশম শ্রেণির চার ছাত্রী ও প্রথম আলোর সাতক্ষীরা কার্যালয়ের মাধ্যমে তাঁরা বাল্যবিবাহ আয়োজনের বিষয়টি জানতে পারেন। গতকাল সকালে তিনি বাল্যবিবাহ কমিটির কয়েকজন সদস্যকে ওই ছাত্রীর বাড়িতে পাঠান। তাঁরা মেয়েটির মাকে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে বোঝালে তিনি বিয়ে বন্ধ করতে রাজি হন। তিনি ১৮ বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দেবেন না বলে মুচলেকাও দেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির হস্তক্ষেপে সাতক্ষীরায় বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা পায় এক কিশোর ও এক কিশোরী। সাকিবুর রহমান বলেন, শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর সঙ্গে এলাকার নবম শ্রেণির এক ছাত্রের বিয়ের উদ্যোগ নেয় তাদের পরিবার। কিন্তু মেয়ে ও ছেলের বিয়ের বয়স না হওয়ায় পরিবারের সদস্যরা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে অ্যাফিডেভিট করে তাদের বয়স বাড়িয়ে নিতে চেয়েছিলেন। এ জন্য পাত্র-পাত্রীকে নিয়ে তাদের বাবা-মা সাতক্ষীরা জজকোর্ট এলাকায় আসেন। খবর পেয়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির সদস্যরা সেখানে যান। অবস্থা বুঝে ছেলে-মেয়ের বাবা-মা গা ঢাকা দেন।
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় গতকাল দুই স্কুলছাত্রীর বিয়ে বন্ধ করে উপজেলা প্রশাসন এবং পুলিশ। পরে অভিভাবকদের কাছ থেকে মুচলেকা আদায় করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা পাওয়া নবম শ্রেণির ছাত্রীর (১৫) বাড়ি উপজেলা সদরের জায়ফরনগর এবং সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীর (১৩) বাড়ি পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নে। নবম শ্রেণির ছাত্রীর পরিবার অসচ্ছল। তার মামারা বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে দুবাইপ্রবাসী এক যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করেছিলেন। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীটির বাবা নেই। তাদের পরিবারও দরিদ্র। তার ভাইয়েরা নবম শ্রেণির ছাত্রীটির মামার সঙ্গে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীর বিয়ে ঠিক করেন। গতকাল রাতে ওই দুটি বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।
খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অসীম চন্দ্র বণিক ও জুড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জালাল উদ্দিন বিকেলে পুলিশ নিয়ে দুই ছাত্রীর বাড়িতে যান এবং অভিভাবকদের বুঝিয়ে বিয়ে বন্ধ করেন।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা প্রশাসন সূত্র বলেছে, গতকাল উপজেলার পরৈকোড়া ইউনিয়নে নবম শ্রেণির এক ছাত্রীর সঙ্গে এক যুবকের (২৫) বিয়ে ঠিক হয়। বর আসার আগে বেলা ১১টায় মেয়ের বাড়িতে পুলিশ নিয়ে উপস্থিত হন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আবদুল মোবিন। তিনি মেয়ের বাবার কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে বিয়ে বন্ধ করেন।
বৃহস্পতিবার সাতকানিয়া পৌরসভায় সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ে বন্ধ করেন ইউএনও মোহাম্মদ মোবারক হোসেন।
কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষার্থীর (১৪) বিয়ে বন্ধ হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন সূত্র বলেছে, দুলালপুর ইউনিয়নের ওই কিশোরীর সঙ্গে দেবীদ্বার উপজেলার এক কাঠ ব্যবসায়ীর বিয়ে ঠিক হয়। বিয়ে ঠিক হওয়ায় বৃহস্পতিবার সে পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। খবর পেয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সম্রাট খীসা ও মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা আফরোজা বেগম কিশোরীর বাড়িতে গিয়ে বিয়ে বন্ধ করেন।
খুলনা নগরের সোনাডাঙ্গা থানা এলাকায় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি বাল্যবিবাহ বন্ধ করা হয়েছে। বরের (২০) বাবা সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের গাড়িচালক। মেয়ের বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলায়। বরের বয়স ২১ বছর না হওয়ায় বিয়েটি বন্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া উপযুক্ত বয়স না হওয়া পর্যন্ত বিয়ের উদ্যোগ নেওয়া হবে না বলে বরপক্ষের অভিভাবকের কাছ থেকে মুচলেকা আদায় করা হয়েছে।
নোয়াখালীরকোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নে সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ে ছিল গতকাল দুপুরে। উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সে বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা পায়। বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য রান্না করা খাবার স্থানীয় এতিমখানায় দিয়ে দেওয়া হয়।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ওই ছাত্রীর সঙ্গে উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের কাতারপ্রবাসী মো. মহি উদ্দিনের (২৮) বিয়ের আয়োজন করা হয়। খবর পেয়ে তিনি পুলিশ নিয়ে মেয়ের বাড়িতে গিয়ে বিয়ে বন্ধ করেন।
ময়মনসিংহ: নান্দাইলে বৃহস্পতিবার অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ে বন্ধ করেছে উপজেলা প্রশাসন। আর বাল্যবিবাহ নিবন্ধন করানোর অভিযোগে আবদুল মালেক (৫০) নামের এক ভুয়া নিকাহ নিবন্ধককে আটক করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে কেউ মামলা করতে রাজি না হওয়ায় মুচলেকা রেখে গতকাল সকালে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ঢাকা: ধামরাইয়ের উপজেলা প্রশাসন সূত্র বলেছে, বৃহস্পতিবার নবম শ্রেণির এক ছাত্রীর (১৪) বিয়ের আয়োজন চলছিল। এলাকাবাসীর মাধ্যমে জানতে পেরে ধামরাইয়ের ইউএনও আবুল কালাম বিয়ে বন্ধে ব্যবস্থা নিতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাহিদ হাসানকে নির্দেশ দেন। তিনি দুপুর ১২টার দিকে মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে বিয়ে বন্ধ করেন।
নওগাঁ: বুধবার রাতে নওগাঁর রানীনগরে ইউএনওর হস্তক্ষেপে বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা পেয়েছে সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রী। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র বলেছে, উপজেলার পারইল ইউনিয়নের একটি গ্রামে ওই ছাত্রীর বিয়ের আয়োজনের খবর মুঠোফোনে ইউএনও সোনিয়া বিনতে তাবিবকে জানান এক গ্রামবাসী। তিনি তৎক্ষণাৎ রানীনগর থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমানকে বিয়ে বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন। থানা-পুলিশ দ্রুত ওই গ্রামে গিয়ে বিয়ে বন্ধ করে দেয়।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]