রাজধানীর একটি বাজার থেকে কেজি দরে তরমুজ কিনতে বাধ্য হওয়ায় ক্ষুব্ধ হন এক ক্রেতা। তাঁর প্রশ্ন, তরমুজ কেন ওজন করে কেজি দরে বিক্রি হবে! তরমুজ তো বিক্রি হওয়ার কথা পিস হিসেবে। এ নিয়ে অভিযোগ জানাতে এই ক্রেতা জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে (৯৯৯) ফোন করেন।
সম্প্রতি আরেক ক্রেতা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে সহায়তা চান। তাঁর অভিযোগ, এক কেজির প্যাকেটজাত চিনির মোড়কে দাম লেখা ৮৫ টাকা। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে দোকানি ১০৫ টাকা নিয়েছেন।
৯৯৯ জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর। কিন্তু ইদানীং বিভিন্ন পণ্য ও তার বাড়তি দাম নিয়ে ক্ষুব্ধ অনেক ভোক্তা এ নম্বরে ফোন করে অভিযোগ জানিয়ে প্রতিকার চাইছেন।
পণ্যের বাড়তি দাম নিয়ে এখন দিনে গড়ে ২০ থেকে ২৫টি ফোনকল আসে বলে জানিয়েছেন জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
পণ্যের দাম নিয়ে অভিযোগ জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরের আওতাভুক্ত না হওয়ায় এ-সংক্রান্ত ফোনকল আলাদাভাবে তালিকাভুক্ত করছে না কর্তৃপক্ষ।
৯৯৯ নম্বরে আসা কলের বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে সবচেয়ে বেশি ফোন এসেছে মারামারির ঘটনা নিয়ে। দ্বিতীয় শীর্ষ অভিযোগ শব্দদূষণ-সংক্রান্ত। শীর্ষ ১০ অভিযোগের মধ্যে বাকিগুলো হলো অগ্নিকাণ্ড, চিকিৎসাসেবা, অ্যাম্বুলেন্স সেবা, দুর্ঘটনা, ভূমি দখল, জঙ্গি কর্মকাণ্ড, নারীর প্রতি সহিসংতা, পারিবারিক সমস্যা ও চুরি।
৯৯৯ সেবার দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, গত বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত ১৫ ব্যক্তি পণ্যের দামসংক্রান্ত বিষয়ে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে ফোন করেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ জানতে চান, দোকানি পণ্যের দাম বেশি রাখায় তাঁরা কোথায় অভিযোগ জানাবেন।
৯৯৯ সেবাটি বাংলাদেশ পুলিশের অধীন পরিচালিত হচ্ছে। এ সেবার প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে সাধারণ মানুষ ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের কাছে চাওয়া সেবাগুলো পেয়ে থাকেন। তবে এখানে প্রায় প্রতিদিনই পণ্যের দাম নিয়ে কিছু কল আসতে দেখা যাচ্ছে। পণ্যের দামসংক্রান্ত অভিযোগ জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরের আওতাভুক্ত নয়। এ রকম আওতাবহির্ভূত কল অভিযোগ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয় না। এসব কল ‘অন্যান্য কল’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।
জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে পণ্যের দাম নিয়ে অভিযোগ এলে সে ক্ষেত্রে কী করা হয়, এমন প্রশ্নে তবারক উল্লাহ বলেন, ‘পণ্যের বাড়তি দাম নিয়ে যাঁরা অভিযোগ করেন, তাঁদের জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের হটলাইন নম্বর দিয়ে সেখানে তথ্যপ্রমাণসহ অভিযোগ জানাতে বলা হয়।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের হটলাইন নম্বর ‘১৬১২১ ’। এ নম্বরকে ‘ভোক্তা বাতায়ন’ বলা হয়। ২০২০ সালের ১৫ মার্চ ‘ভোক্তা বাতায়ন’ চালু হয়।
গত রোববার রাত ৯টা ১০ মিনিটে ভোক্তা বাতায়নে ফোন করেন এই প্রতিবেদক। ফোনটি ধরেন ভোক্তা বাতায়নের প্রতিনিধি পরিচয় দেওয়া ফুয়াদ আল মারুফ।
ফুয়াদ আল মারুফ জানান, তাঁরা প্রতিদিনই পণ্যের মূল্য নিয়ে ভোক্তাদের বিভিন্ন অভিযোগ পেয়ে থাকেন। কিছুদিন আগে সয়াবিন তেল নিয়ে বেশি অভিযোগ এসেছিল। ইদানীং পণ্যের মোড়কের গায়ে লেখা মূল্যের চেয়ে বাড়তি দাম নেওয়া, তরমুজ কেজিতে বিক্রি করা প্রভৃতি অভিযোগ বেশি আসছে।
গত শনিবার হটলাইনে মোট ১৭৬টি কল আসে জানিয়ে ভোক্তা বাতায়নের এই প্রতিনিধি বলেন, তাঁরা প্রমাণসহ লিখিত অভিযোগ দিতে ভোক্তাদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
পণ্যমূল্য নিয়ে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করার বিষয়টিকে মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করেছেন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান।
ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জিনিসপত্রের দাম অসহনীয় হয়ে উঠছে। এতে সাধারণ মানুষ অসহায় বোধ করছেন, ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। তাঁরা এর বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন জাতীয় জরুরি সেবার নম্বরে ফোন করে।
পণ্যের দাম বাড়ার কারণ চিহ্নিত করে সমাধানে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করেন ক্যাব সভাপতি।
তিন বছর ধরে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে সবচেয়ে বেশি ফোনকল এসেছে মারামারির ঘটনা নিয়ে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৯৯৯ নম্বরে মারামারি নিয়ে কল আসে ১৬ হাজার ৩২৬টি। সে হিসেবে, এ সময়ে ৯৯৯ নম্বরে আসা মোট অভিযোগের ২৬ শতাংশ মারামারি-সংক্রান্ত।
২০২১ সালে মারামারির অভিযোগ জানিয়ে ৯৯৯ নম্বরে কল এসেছিল ৪৮ হাজার ৪৩০টি, যা ছিল মোট কলের ২৬ শতাংশ। একই বিষয়ে ২০২০ সালে কল এসেছিল ৩৪ হাজার ৯৩২টি, যা মোট কলের ২২ শতাংশ।
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে শব্দদূষণ নিয়ে ৮ হাজার ৪০৮টি অভিযোগ আসে। এ ছাড়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৮ হাজার ৪৮টি, চিকিৎসা ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা পেতে ৭ হাজার ৪২২টি ও দুর্ঘটনার তথ্য জানিয়ে ৫ হাজার ৮০৫টি কল আসে।
জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরের ফোকাল পারসন (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘৯৯৯ নম্বরে অভিযোগের সংখ্যা বেশি মানে এই নয় যে এসব ঘটনা বেড়েছে। বরং আমি বলব, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে বলেই জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে কল বাড়ছে।’
এ সেবার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে জানান আনোয়ার সাত্তার। ৯৯৯ নম্বরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অভিযোগকারীর অবস্থান শনাক্তের ব্যবস্থা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যিনি ফোন করেন, তাঁর অবস্থান স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করার ব্যবস্থা এখানে নেই। বিষয়টি সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে একটা সমস্যা তৈরি করে। দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিরা অনেক সময় ফোনে তাঁদের অবস্থানের কথা সঠিকভাবে বলতে পারেন না। অনেক প্রশ্ন করে দুর্ঘটনার স্থান সম্পর্কে ধারণা করে নিতে হয়। এতে অনেক সময় সেবা দিতে দেরি হয়।’