স্বামীর মারধরে পাশের ফ্ল্যাটে আশ্রয় নিয়েছিলেন এক নারী। তাতেও নিস্তার মেলেনি। সেই ফ্ল্যাটের দরজায় গিয়েও ধাক্কা দিচ্ছিলেন স্বামী। রূঢ়ভাবে বাসায় ফিরে আসতে বলছিলেন। আবারও মারধরের শিকার হতে পারেন এমন আশঙ্কায় পুলিশের দ্বারস্থ হন ওই নারী। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এ ফোন দিলে পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়।
এ ঘটনা গত ১২ মে রাজধানীর কল্যাণপুরের একটি বাসার। তবে ব্যক্তিগত সুরক্ষার প্রশ্নে ভুক্তভোগী নারী বা তাঁর স্বামীর পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। শুধু কল্যাণপুরের ওই ঘটনাই নয়, জাতীয় জরুরি সেবার নম্বরে মে মাসে গৃহবিবাদের এমন ৯৩৪টি ফোন এসেছে। কোথাও স্বামী-স্ত্রীর কলহ, কোথাও ভাইবোনের, আবার কোথাও শিশুর ওপর নির্যাতন। অথচ গত বছরের মে মাসে এই সংখ্যা ছিল ৪৯১।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী নারীর ওপর সহিংসতা বেড়েছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব রয়েছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতনের ২ হাজার ১৬১টি ফোন এসেছিল জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে। এ বছরের ২২ জুন পর্যন্ত সেই সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৭০৭।
শুধু স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া নয়, ভাইবোনের মধ্যে ঝগড়ার পরও পুলিশের সহায়তা চেয়েছেন কেউ কেউ। এমনই এক ঘটনা ঘটে গত ৭ মে রাজধানীর ভাটারার চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকায়। নিজের বোনকে পিটিয়ে একটি কক্ষে আটকে রেখেছিলেন ভাই। পরে ৯৯৯–তে ফোন দিলে পুলিশ গিয়ে বোনকে উদ্ধার করে।
>গত বছরের ছয় মাসে নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতনের ফোন ছিল ২ হাজার ১৬১ টি। এ বছরের ছয় মাসে সেই সংখ্যা ৫ হাজার ৭০৭।
ফোনকলের পরিসংখ্যান এবং বিভিন্ন ব্যতিক্রম ঘটনা সংরক্ষণ করেন ৯৯৯–এর ইনস্ট্রাক্টর এম এন অনিক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কয়েকটি ঘটনার ক্ষেত্রে ফোন পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশকে বিপাকেও পড়তে হয়েছে। ১৩ এপ্রিল রাত সাড়ে ১২টায় ধানমন্ডি থেকে এক প্রতিবেশী ফোন করে জানান, তাঁর পাশের ফ্ল্যাটে স্ত্রীকে মারধর করছেন স্বামী। চিৎকার–চেঁচামেচিতে তাঁরা ঘুমাতে পারছেন না। বিষয়টি ধানমন্ডি থানার পুলিশকে জানালে তারা ঘটনাস্থল যায়। তখন স্বামী-স্ত্রী দুজনই চড়াও হন পুলিশের ওপর। তাঁরা নিজেরা অভিযোগ করেননি, তারপরও পুলিশ কেন এসেছে, এর জবাব চান। একপর্যায়ে প্রতিবেশীর সহায়তায় বিষয়টির মীমাংসা করতে হয় পুলিশকে।
নাগরিকের যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে মুঠোফোন থেকে ৯৯৯–এ বিনা পয়সায় ফোন করতে পারেন। প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে এই সেবা। ৯৯৯ সার্ভিসের প্রশিক্ষিত কর্মীরা প্রয়োজন অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ বা অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রদানকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। ৯৯৯ নম্বরে কেউ ফোন করলে সমস্যার ধরন, নাম-পরিচয় ও ঠিকানা জেনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
২০১৭ সালে এই সেবা চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ২ কোটি ৭৬ লাখ ৩৩৫টি ফোন এসেছে। এগুলোর মধ্যে ৭৮ দশমিক ৩২ শতাংশ বা ১ কোটি ৬২ লাখ ৬১ হাজার ৪৮৪টি কলে কোনো সেবা দেওয়া হয়নি। কোনো কারণ ছাড়াই এসব কল করা হয়েছিল। সেবা দেওয়া হয়েছে ৪৫ লাখ ৩ হাজার ৮৫১টি কলের বিপরীতে।
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এর প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক তবারক উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর প্রথম দিকে তাঁরা ভাইরাস–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কল পাচ্ছিলেন। মানুষ ছোটখাটো বিভিন্ন তথ্য জানতে চাইছিল। প্রায় ৪ লাখ ১৮ হাজার ১৩৫টি এমন কলে ১৮ হাজার ৪০৩টি জায়গায় পুলিশ সদস্যকে পাঠাতে হয়েছে। করোনার জন্য অন্যান্য হটলাইন চালু হওয়ার পর এই সংখ্যা কমে এসেছে।
জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসি সুলতানা নারী ও শিশুদের ওপর নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার পেছনে মহামারির বিশেষ পরিস্থিতির কয়েকটি দিকের কথা বলছেন। তাঁর মতে, কাজ হারিয়ে ফেলায় অনেকেই খাবারের মতো মৌলিক চাহিদার ঠিকমতো জোগান দিতে পারছেন না। অনেকেরই কর্মক্ষেত্রের অনিশ্চিত পরিস্থিতি হতাশা ও অস্থিরতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেকেই গৃহকর্মী বাদ দেওয়ায় গৃহকাজ বেড়ে গেছে। এতেও পরিবারের সদস্যদের ওপর চাপ বেড়েছে। এসব কারণেই সহিংসতা বাড়ার পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে।