বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক

৯টি জেব্রার মৃত্যু ঘিরে ‘রহস্য’

তিন সপ্তাহের মধ্যে ৯টি জেব্রার মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখছে সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষ। আজ বিশেষজ্ঞদের বৈঠক।

গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে জেব্রার দল। গতকাল দুপুরে। প্রথম আলো
গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে জেব্রার দল। গতকাল দুপুরে।  প্রথম আলো

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে পরপর নয়টি জেব্রার মৃত্যু হয়েছে। ২ জানুয়ারি থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে জেব্রাগুলো মারা যায়। পার্কটিতে মোট ৩১টি জেব্রা ছিল। ৯টির মৃত্যুর পর এখন সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২–এ। এভাবে নয়টি জেব্রার মৃত্যু অনেকেই রহস্যজনক মনে করছেন।

গাজীপুরের শ্রীপুরে অবস্থিত এই সাফারি পার্ক দীর্ঘ দিন ধরে জেব্রার পালে সমৃদ্ধ হচ্ছিল। কিছুদিন পরপর জেব্রার পালে আসছিল নতুন অতিথি। ক্রমাগত সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এখান থেকে জাতীয় চিড়িয়াখানায় কিছু জেব্রা পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু হঠাৎ এমন মৃত্যু পার্ক–সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।

তিন সপ্তাহের মধ্যে নয়টি জেব্রার মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখছে সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষ। খাদ্যে বিষক্রিয়া, বিষ প্রয়োগ, ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণসহ নানা বিষয় মাথায় রেখেই আজ মঙ্গলবার পার্কের অভ্যন্তরে বিশেষজ্ঞদের বৈঠক বসবে। সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক মো. জাহিদুল কবির জানান, আজকের বৈঠকে থাকবেন বিশেষজ্ঞ প্রাণী চিকিৎসক, গবেষক ও পার্ক–সংশ্লিষ্ট লোকজন।

পার্ক–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২ জানুয়ারি একটি জেব্রা মারা যাওয়ার পর মৃতদেহের নমুনা ঢাকার সাভারে অবস্থিত মান নিয়ন্ত্রণ গবেষণাগার এবং ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে পাঠানো হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল এরই মধ্যে এসেছে।

সরেজমিন সাফারি পার্কের জেব্রার বেষ্টনী ঘুরে দেখা যায়, সাফারির ভেতর বিশাল এলাকাজুড়ে এগুলোর বসতি। সেখানে জেব্রার চারণভূমিতে আছে কৃত্রিম লেক ও প্রাকৃতিক বন। খাবার দেওয়ার জন্য রয়েছে বিশেষ পাত্র। সেখানে একই সঙ্গে খাবার খায় ওয়াইল্ড বিস্ট ও জেব্রা। সরবরাহ করা খাবার ছাড়াও চারণভূমির ঘাস খায় জেব্রাগুলো। এ ছাড়া জেব্রার চারণভূমিজুড়ে উন্মুক্তভাবে চলাফেরা করে বানর।

পার্ক সূত্র জানায়, জেব্রার খাবার মূলত বিভিন্ন ধরনের ঘাস। সাফারি পার্কে জেব্রার ঘাস সরবরাহ করে মাহবুব এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। চারণভূমির ঘাস খাওয়ার পাশাপাশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ঘাস এনে জেব্রাগুলোকে খাওয়ানো হয়।

সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সহকারী বন সংরক্ষক তবিবুর রহমান ঘাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের অন্যতম স্বত্বাধিকারী সিরাজুল ইসলামকে নিয়ে মানিকগঞ্জে অবস্থান করছিলেন। তবিবুর রহমান গতকাল বেলা তিনটায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেহেতু বিষক্রিয়ার বিষয়টি এসেছে, তাই আমরা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের একজনকে নিয়ে ঘাস যেসব এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়, সেসব এলাকা পরিদর্শন করছি। ঘাস উৎপাদনকারী কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছি। সেখান থেকে বিভিন্ন ধরনের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। সাফারি পার্কের চারণভূমির ঘাস ও মাটি পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।’ নয়টি জেব্রার মৃত্যুর বিষয়ে তিনি বলেন, মঙ্গলবার (আজ) এ বিষয়ের ওপর বিশেষজ্ঞরা বৈঠক করবেন। সেখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে পরীক্ষায় পাওয়া ফলাফল বিশ্লেষণ করা হবে। এরপর জানা যাবে জেব্রার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ। তবিবুর রহমান আরও বলেন, মৃত জেব্রার পাকস্থলীর বিভিন্ন নমুনা পরীক্ষা করে নাইট্রো ফসফরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। মাহবুব এন্টারপ্রাইজের কারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক মো. জাহিদুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান চলছে। প্রতিটি মৃতদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে। মৃতদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় নমুনা পরীক্ষা চলমান আছে। তিনি বলেন, ‘সাফারি পার্কের নিরাপত্তায় ঘাটতি নেই। বাইরে থেকে কেউ এসে বিষ প্রয়োগ করবে, এমন ঘটার কথা নয়। তবু আমরা এগুলো মাথায় রেখেই মঙ্গলবারের বৈঠকে বসছি। সবকিছু রিপোর্টের ওপর নির্ভর করছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা মতামত দেবেন। আমরা বৈঠকের পর সবকিছু জানতে পারব।’

অন্যান্য প্রাণীর মৃত্যু

২০১৩ সালে পার্ক প্রতিষ্ঠার পর দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বাঘ, সাদা বাঘ, সিংহ, জিরাফ, জেব্রা, হরিণ, ক্যাঙ্গারু, কালো ভালুক, সাম্বার, গয়াল, হাতিসহ প্রচুর প্রাণী ও পাখি আনা হয়। তবে গত আট বছরে বাঘ, জিরাফ, ক্যাঙ্গারু, জেব্রাসহ বিভিন্ন প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। মারা গেছে দুর্লভ কিছু পাখি। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে চোরাকারবারিদের কাছ থেকে উদ্ধার ও দেশের বনাঞ্চল থেকে বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার করা প্রাণী ও পাখির বেশির ভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে এসেছে। জব্দ প্রাণীর সবচেয়ে বড় চালান এসেছিল ২০১৮ সালের মে মাসে। তখন যশোরে চোরাকারবারিদের কাছ থেকে জব্দ করা আটটি জেব্রা একসঙ্গে আনা হয়েছিল সাফারি পার্কে। এর আগে গুইসাপ খেয়ে একটি বাঘের মৃত্যু হয়েছিল। নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ ও রোগাক্রান্ত হয়ে গত আট বছরে বেশ কয়েকটি জিরাফের মৃত্যু হয়। সর্বশেষ গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর অতিরিক্ত গরমে একটি সাদা সিংহের মৃত্যু হয়। মৃত পাখি ও প্রাণী দর্শনার্থীদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে সাফারি পার্কে।