এখন মোট ডিজিটাইজড অ্যাকাউন্ট সুবিধার আওতায় ৮৮ লাখের বেশি ভাতাভোগী। এ বছর যুক্ত হবে আরও ২০ লাখ।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৭৬ লাখ ভাতাভোগীর ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট তৈরি শেষে এর মধ্যে ৮৭ হাজারের খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাঁদের ‘নিরুদ্দেশ’ উল্লেখ করে নতুন ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট তালিকা করা হয়েছে। ‘নিরুদ্দেশ’ ভাতাভোগীদের মধ্যে অনেকেই ভুয়া বলে জানিয়েছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। নিখোঁজ ব্যক্তিদের জায়গায় নতুন করে ৮৭ হাজার ভাতাভোগীকে তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নতুন তালিকা ধরে ৩০ জুন থেকে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ও প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি দেওয়া শুরু হয়েছে। দুই কিস্তিতে জিটুপি (গভর্নমেন্ট টু পারসন) পদ্ধতিতে ভাতাভোগীর মুঠোফোনের ডিজিটাল অ্যাকাউন্টে ৯ মাসের বকেয়া ভাতা দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়ার কারণে গত বছরের অক্টোবর থেকে ভাতা দেওয়া বন্ধ ছিল। মাঝে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে কোনো কোনো জেলায় আংশিক ভাতা দেওয়া হয়।
সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক ভাতা প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু মধ্যস্বত্বভোগী ও ভুয়া ভাতাভোগী থাকার অভিযোগ ছিল। ভাতাভোগীদের অনেকে পুরো অর্থ হাতে পান না, এমন অভিযোগও ছিল। আবার ভাতাভোগীদের ভাতা তুলতে উপজেলায় গিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হতো। তাই ভাতাভোগীদের হাতে সরাসরি অর্থ পৌঁছে দিতে ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট তৈরির কাজ শুরু হয়।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ৭৬ লাখ ভাতাভোগীর নতুন তালিকা তৈরি করার পর দেখা গেছে, ৮৭ হাজার নিখোঁজ। অ্যাকাউন্ট তৈরির জন্য তথ্য জোগাড় করতে গিয়ে এসব লোকজনকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধারণা করা যায়, এর মধ্যে অনেক ভুয়া ভাতাভোগী ছিলেন। এসব নাম বাদ যাওয়ায় সরকারের অর্থ বেঁচে গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১২৩টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চলছে। এতে বাজেট রয়েছে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা।
ধারণা করা যায়, এর মধ্যে অনেক ভুয়া ভাতাভোগী ছিলেন। এসব নাম বাদ যাওয়ায় সরকারের অর্থ বেঁচে গেছে।মো. আশরাফ আলী খান, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ও প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি ভাতাভোগীর মোট সংখ্যা ৮৮ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে ২১ জেলার ৭৭টি উপজেলার ১২ লাখ ৫০ হাজার ভাতাভোগীকে ২০১৭-১৮ সালে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের (ব্যাংক এশিয়া, মধুমতি ব্যাংক লিমিটেড ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক) মাধ্যমে ভাতা দেওয়া শুরু হয়। গত বছরের অক্টোবর থেকে ৪৯৫টি উপজেলায় জিটুপি পদ্ধতিতে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে ৭৬ লাখ ভাতাভোগীর অ্যাকাউন্ট ডিজিটাইজেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) সফটওয়্যার ব্যবহার করে ভাতাভোগীদের ডেটাবেইস করা হয়। মুঠোফোনে অর্থ লেনদেন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে দেশজুড়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে।
নোয়াখালী সদর উপজেলার সমাজসেবা কর্মকর্তা শ্যামল চন্দ্র পাল প্রথম আলোকে বলেন, নতুন তালিকা অনুসারে তাঁর এলাকায় ভাতাভোগীর সংখ্যা ২০ হাজার ২৫৭। তালিকা করার সময় দেড় হাজারের মতো ভাতাভোগীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে ক্ষেত্রে নিরুদ্দেশ ব্যক্তিরা সব ভুয়া ছিলেন, ব্যাপারটা তা নয়। ডিজিটাইজেশনের জন্য ডেটা এন্ট্রির কাজ করার সময় জীবিত ছিলেন এমন কিছু ব্যক্তি ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট করার আগে মারা গেছেন। বয়স্ক ভাতা পান এমন কারও কারও জাতীয় পরিচয়পত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে বয়স কম পাওয়া গেছে, তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে। ‘নিরুদ্দেশ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত দেড় হাজার ব্যক্তির জায়গায় নতুন ভাতাভোগীর নাম প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
রাজধানীর কল্যাণপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়ার ফাতেমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর প্রতিবন্ধী ছেলে রাব্বি ইসলাম (১৫) জুন মাসের শেষ দিকে বকেয়া ভাতাসহ নতুন ভাতা পেয়েছে। তবে তাঁর প্রতিবেশী এক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ভাতা পাননি।
একই এলাকার আমিরন খাতুন ও তাঁর স্বামী বেলায়েত হোসেন বয়স্ক ভাতায় তালিকাভুক্ত। তাঁরা ভাতা পাননি বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।
এমন অভিযোগ বেশ কয়েকজন ভাতাভোগী করেছেন বলে জানিয়েছেন কল্যাণপুরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বেশ কয়েক দিন আগে ঝরনা বেগম নামের একজন বয়স্ক ভাতাভোগী অভিযোগ করেছেন, যে মুঠোফোন নম্বর দিয়েছিলেন সেটিতে ভাতা পাঠানো হয় না, অন্য নম্বরে পাঠানো হয়। আরেক ভাতাভোগী অভিযোগ করেছেন, তাঁর ভাতা গাইবান্ধার অপর এক ব্যক্তির মুঠোফোনে চলে গেছে। তিনি ওই ব্যক্তির কাছে ভাতার টাকা ফেরত চাইলে তিন হাজার টাকার মধ্যে দুই হাজার ফেরত পাঠান। কাউন্সিলর বলেন, ‘আমি এসব বিষয় সংশ্লিষ্ট সমাজসেবা কর্মকর্তাকে জানিয়েছি।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল রোববার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিযোগগুলো পেয়েছি। কিছু সমাধান হয়েছে। কিছু প্রক্রিয়াধীন আছে। যাঁরা সমস্যায় পড়েছেন, তাঁরা স্থানীয় সমাজসেবা কার্যালয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ভাতাভোগীর বই নিয়ে গেলে সমাধান পাবেন।’
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ১৫০টি উপজেলার আরও ২০ লাখের মতো নতুন ভাতাভোগী যুক্ত করা হবে। এতে মোট ভাতাভোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ৯ লাখের মতো। তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে আবেদন করতে হবে। ৩১ আগস্টের মধ্যে ইউনিয়ন পর্যায়ে এবং ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে উপজেলা, পৌর ও মহানগর পর্যায়ে যাচাই–বাছাইয়ের কাজ শেষ হবে। নভেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত তালিকাভুক্তির কাজ শেষ করা হবে।