রেল দুর্ঘটনার ৮০ শতাংশের বেশি ঘটছে কর্মীদের ভুলে কিংবা অবহেলায়। চালকের দোষে গত সোমবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ট্রেন দুর্ঘটনায় ১৬ জনের প্রাণহানি হয়। আর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার দুর্ঘটনার পেছনে প্রাথমিকভাবে স্টেশনমাস্টার অথবা লাইন মেরামতে যুক্ত কর্মীদের ভুল দেখছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। এভাবে একের পর এক ট্রেন দুর্ঘটনায় রেল ব্যবস্থাপনা দিন দিন ভেঙে পড়ছে কি না, সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, গত পাঁচ বছরের দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনার দুটি কারণ পাওয়া যায়। প্রথমত, মানবিক ভুল (হিউম্যান এরর); দ্বিতীয়ত, কারিগরি ত্রুটি। গড়ে ৮০ শতাংশের বেশি দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মানুষের ভুল। অর্থাৎ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ভুলে বা অবহেলায় দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুষের ভুলের মধ্যে রয়েছে লাইন পরিবর্তনের জোড়া (পয়েন্টস) ভুলভাবে স্থাপন করা ও ভুল সংকেত দেওয়া। এ কাজগুলো সাধারণত স্টেশনমাস্টার ও তাঁর অধীন ব্যক্তিদের কাজ। সংকেত ও যথাযথ গতিনির্দেশিকা না মেনে ট্রেন চালান চালক ও সহকারী চালকেরা। অন্যদিকে কারিগরি ত্রুটির মধ্যে লাইনের ত্রুটি, ইঞ্জিন-কোচের ত্রুটি বড়।
রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ে সূত্র বলছে, মানুষের ভুল এড়ানো সম্ভব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। কড়া শাস্তি দিয়েও দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায়। কিন্তু রেলে মানুষের করা ভুল শোধরানোর জন্য তেমন কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। আর শাস্তি কেবল নিচের দিকের কর্মীদের হয়। তদন্তে বড় কর্মকর্তাদের নাম আসে না, শাস্তিও হয় না। তবে কারিগরি ত্রুটি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও লোকবল আছে। গত ১১ বছরে রেলের উন্নয়নে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকার। লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সাড়ে ১৩ হাজারের বেশি।
রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ের দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তিন দিনের ব্যবধানে দুটি বড় দুর্ঘটনা ঘটল কর্মীদের ভুলে। এর আগে কুলাউড়ার দুর্ঘটনা ঘটেছে লাইনে ত্রুটির কারণে। অর্থাৎ রেলের কর্মীরা যেমন ভুল করছেন। আবার কারিগরি ত্রুটিও আছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে রেলের ব্যবস্থাপনায়ও গলদ আছে। তাঁরা বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই রেল লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চলছে। দৈনন্দিন রেল পরিচালনাতেই বছরে লোকসান প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। সারা বিশ্বেই রেলকে নিরাপদ বাহন মনে করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে লোকসানের পাশাপাশি এর নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েও এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
গত সোমবার রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় তূর্ণা নিশীথা ও উদয়ন এক্সপ্রেসের মধ্যে সংঘর্ষে ১৬ জন প্রাণ হারান। আহত হন শতাধিক। বৃহস্পতিবার সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন ও সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে আগুন ধরে যায়। এতে ২৫ জন আহত হন। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কোটি টাকার ওপরে। এর আগে গত ২৩ জুন রাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের ছয়টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পাঁচ যাত্রী মারা যান। আহত হন শতাধিক। রেলের তদন্ত কমিটি এ ঘটনার জন্য লাইনের ত্রুটিকে দায়ী করে। অথচ প্রতি ইঞ্চি রেললাইন নিরাপদ কি না, তা দেখার জন্য কি-ম্যান, ওয়েম্যান, গ্যাং-ম্যানসহ নানা পদের কর্মচারী আছেন।
রেলের সচিব মোফাজ্জাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দুটি দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর দায়ীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। কর্মীদের ভুলে এভাবে দুর্ঘটনার পেছনে অব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণের অভাব আছে কি না, তা জানতে চাইলে সচিব বলেন, রেল একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যবস্থা। কোনো পর্যায়ে কেউ দায়িত্ব পালন না করলে এর খেসারত দিতে হয়। ফলে সব পর্যায়ে সমান দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা জরুরি। সেটা নিশ্চিত করা এবং প্রশিক্ষণে জোর দিচ্ছেন তাঁরা।
অবহেলায় পরপর দুটি দুর্ঘটনা
কসবায় দুর্ঘটনার পর পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গতকাল শুক্রবার একটি তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত হয়েছে। এতে চালক ও পরিচালককে (গার্ড) দায়ী করা হয়।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, চালক ও সহকারী চালক ঘুমিয়ে ছিলেন। নতুবা তাঁরা স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন না। আর উল্লাপাড়ার দুর্ঘটনার দায় নিয়ে রেলের পরিচালন (অপারেশন) ও পুরকৌশল (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) বিভাগের মধ্যে রশি–টানাটানি চলছে। পরিচালন বিভাগ বলছে, দুর্ঘটনাটি ঘটেছে লাইন পরিবর্তনের জোড়ার (পয়েন্টস) ২০ মিটার আগে। সেখানে পুরকৌশল বিভাগের কর্মীরা দুর্ঘটনার আগে মেরামতকাজ করেছেন, যা স্টেশনমাস্টারকে জানানো হয়নি। আর মেরামতও ঠিকভাবে হয়নি। পুরকৌশল বিভাগ বলছে, ট্রেনটি সোজা লাইনে চলে যাওয়ার কথা। স্টেশনমাস্টারের ভুল সংকেতের কারণে স্টেশনে থামার লাইনে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছে রংপুর এক্সপ্রেস।
>শাস্তি হয় ছোটদের, বড় কর্মকর্তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে
প্রশিক্ষণ নেই, ব্যবস্থাপনায় গলদ
রেলওয়ে সূত্র বলছে, রেলে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সর্বোচ্চ কারিগরি নিরাপত্তার বিধান করা আছে। এটা নির্ভর করে রেলের কর্মীদের ওপর। কর্মীরা সেই কাজটিই ঠিকভাবে করছেন না। যেমন, রেলের ইঞ্জিনে এমন কারিগরি ব্যবস্থা আছে যে, চালক ও সহকারী চালক অলস বসে থাকলে ট্রেন চলবেই না। চালক বা সহকারী চালক যদি একটানা ৫০ সেকেন্ড স্পিড বাড়ানো, কমানো, ব্রেক করা, হর্ন দেওয়ার কাজ না করেন, তাহলে এক মিনিটের মধ্যে ট্রেন থেমে যাবে। এর বাইরে ‘ডেডম্যান প্যাডেল’ বলে একটা ব্যবস্থা আছে। অর্থাৎ ব্রেক কিংবা গতি বাড়ানোসহ চালকের যদি কিছুই না করার থাকে, তাহলে চালককে একটি নির্দিষ্ট বাটন চাপতে হয়। মূলত চালকেরা ঘুমিয়ে গিয়ে যাতে দুর্ঘটনায় না পড়েন, সে জন্যেই এই ব্যবস্থা। কিন্তু রেলের প্রায় সব ইঞ্জিনেই এই ব্যবস্থা বিকল করা আছে।
সূত্র জানায়, উল্লাপাড়ায় রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি ওই স্টেশনে না থেমে সরাসরি চলে যাওয়ার কথা। এখানে স্টেশনমাস্টারের কাজ হচ্ছে সোজা মূল যে লাইনে ট্রেনটি চলার কথা, সেই অনুসারে জোড়া (পয়েন্টস) ঠিক করে সংকেত দেওয়া। সেটা তিনি ঠিকভাবে করেছেন কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। স্টেশনমাস্টারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা নিজেরা দায়িত্ব পালন না করে পয়েন্টসম্যানদের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেন।
পুরকৌশল বিভাগের দায়িত্ব হচ্ছে লাইনে ত্রুটি হলে সেটা যথাযথভাবে মেরামত করা। পাশাপাশি তা স্টেশনমাস্টার, এমনকি চালককেও সেটা জানানোর কথা। তদন্ত কর্মকর্তাদের ধারণা, স্টেশনমাস্টার বা প্রকৌশলী নিজের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেননি। লাইন মেরামতের চেয়ে বড় বড় প্রকল্পের পেছনে বেশি ছোটার অভিযোগ আছে প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে।
ভুল শোধরানোর ব্যবস্থা নেই
একের পর এক ভুল হতে থাকলেও কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে রেলের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কয়েক বছর ধরে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি করছে সব মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। রেলের সঙ্গে করা চুক্তি অনুসারে, প্রতিটি কর্মীকে বছরে অন্তত ৬০ ঘণ্টা প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা। কিন্তু গত সেপ্টেম্বরের বৈঠক অনুসারে এ ধরনের প্রশিক্ষণের সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বর্তমানে রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের ভেতরে মাত্র ৫৭৯ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তা–ও সভা-সেমিনার ধরনের প্রশিক্ষণই বেশি। এ সময় প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে গেছেন ১৫৮ জন।
রেল পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের ‘রানিং স্টাফ’ বলা হয়। এর মধ্যে চালক, সহকারী চালক, পরিচালক (গার্ড), স্টেশনমাস্টার রয়েছেন। এঁদের প্রত্যেককে বাধ্যতামূলক ডোপ টেস্ট (মাদক পরীক্ষা) করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু তা হয় না বলে রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে।
রেলের পরিচালনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, আগের সিদ্ধান্ত কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে, তা পর্যালোচনা, ত্রুটি চিহ্নিত করা এবং তা সমাধানের লক্ষ্যে কয়েক মাস পরপর সর্বোচ্চ পর্যায়ে বৈঠক হয়। এটাকে অপারেশনাল রিভিউ মিটিং বলা হয়। গত ৭ অক্টোবরের সর্বশেষ বৈঠকে ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত সব কর্মীর মাদক পরীক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। তবে তা করা হয়নি। ওই বৈঠকে ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য শুধু নিচের স্তরের কর্মীদের দায়ী না করে কর্মকর্তাদেরও দায়ী করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। ট্রেন দুর্ঘটনায় বড় কোনো কর্মকর্তার শাস্তির নজির খুব একটা নেই বলে রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রেলে অব্যবস্থাপনার দুটি কারণ তাঁর চোখে পড়েছে। রেলের জনবলের ওপরের দিকের অর্থাৎ বড় কর্তাদের একটা বড় অংশের মনোযোগ এখন উন্নয়ন প্রকল্পে। কারণ, সেখানে প্রচুর পয়সা আছে। ফলে দৈনন্দিন ট্রেন পরিচালনায় তাঁদের মনোযোগ কম। অন্যদিকে গত এক দশকে নিচের দিকে বিপুল সংখ্যায় লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যাদের একটা বড় অংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি। এদের একটা বড় অংশ পয়সা দিয়ে চাকরি পেয়েছে। ফলে নিজের দায়িত্বটা ঠিকভাবে পালন করছেন না।