বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এই ভাষণ বিশ্বের মানচিত্রে একটি নতুন দেশ সৃষ্টি করে। বাংলা একাডেমি আয়োজিত একক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে এই কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।
আজ বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে এগারোটায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের উপলক্ষে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে এই বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়।
ফরাসউদ্দিন বলেন, কট্টরপন্থী যুবকেরা ৭ মার্চের ভাষণেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে গভর্নর অ্যাডমিরাল এম আহসান ও প্রাদেশিক সামরিক প্রশাসক সাহেবজাদা ইয়াকুব খান বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দেন, স্বাধীনতার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বোমা মেরে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটিয়ে রেসকোর্স ময়দান খালি করে দেওয়া হবে। এই সব চাপের মধ্যে বেগম ফজিলাতুন্নেছার পরামর্শ ছিল, ‘তোমার মনে যা আসে তাকেই সঠিক সিদ্ধান্ত মনে করে ভাষণ দেবা’।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ১৮ মিনিটের ভাষণটি স্বভাবসুলভ তাৎক্ষণিক বক্তব্য ছিল বলে ফরাসউদ্দিন জানান। তিনি বলেন, অনেকে এটিকে রাজনৈতিক কবিতা বলেন। তিনি ঠান্ডা মাথায় হিসাব-নিকাশ করেই ভাষণে স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ ঘোষণা দেননি। কারণ তিনি জানেন, বিশ্বের কেউ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দেবে না। তার এই কৌশলেই শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান ভাঙার দায় পাকিস্তানি সেনা শাসকদের ওপর পড়েছে। যদিও তখন বিভিন্ন বামপন্থী নেতাদের কথা ছিল, বঙ্গবন্ধু প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে ভুল করেছেন। এখন অবশ্য তারা ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে বোল পাল্টে ফেলেছেন।
ফরাসউদ্দিন আরও বলেন, খেলাধুলা, ছোটাছুটি ও দুরন্তপনায় বেড়ে ওঠা শেখ মুজিব শারীরিকভাবে ছিলে শক্তিমান। তাঁর ইস্পাত কঠিন মানসিক গড়নে এই বিষয়টি ভূমিকা রেখেছিল। এই ইস্পাত কঠিন মানসিক গড়নের পরিচয় তিনি ৭ মার্চের ভাষণে রেখেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সঙ্গে আমি নেতাজি সুভাষ বসুর বক্তৃতার মিল পাই। নেতাজি বলেছিলেন, তোমরা আমাকে রক্ত দাও। আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। আর বঙ্গবন্ধু বলেছেন, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। তবুও এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব।
৭ মার্চের ভাষণের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ফরাসউদ্দিন বলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ টিতে জয়ী হয়। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদে বৈঠক বসার কথা ছিল। আচমকা ১ মার্চ ইয়াহিয়া সংসদের অধিবেশন স্থগিত করেন। পূর্ব বাংলায় আগুন জ্বলে ওঠে। এর মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে অভূতপূর্ব এক জাগরণের সৃষ্টি হয়। ব্যাংক, প্রশাসন, বাণিজ্য, যোগযোগ ও শিক্ষাসহ প্রশাসনিক সব ব্যবস্থা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে থাকে। প্রচণ্ড চাপে ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের সভা আহ্বান করেন এবং আলোচনার প্রস্তাব দেন। এই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ তখনকার রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন।
অনুষ্ঠান বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল সংক্ষিপ্ত। কিন্তু তাতে ছিল ইতিহাস ও সমকালের যাবতীয় পরিচয় ও পরিসংখ্যান। মূলত সেদিনই বাঙালি জাতি প্রকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা পেয়ে যায়।