৭২ ঘণ্টা পর মামলা না নেওয়ার নির্দেশনা ন্যায়নীতির পরিপন্থী: সুলতানা কামাল

রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলের ধর্ষণের মামলায় পাঁচ আসামির সবাই খালাস পেয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার রায় দেওয়ার পর আদালত নির্দেশনা দিয়েছেন, ধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে ৭২ ঘণ্টা পার হলে পুলিশ যেন মামলা না নেয়। এ নির্দেশনার বিষয়টি নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয়েছেন নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা। এ বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা।

সুলতানা কামাল
ফাইল ছবি
প্রশ্ন

প্রথম আলো: রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণী ধর্ষণের মামলায় পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দিয়েছেন আদালত। এটি বহুল আলোচিত একটি মামলা। রায়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

সুলতানা কামাল: এককথায় এ রায়ে আমার প্রতিক্রিয়া জানাতে হলে বলতে হয়, রায়টি অত্যন্ত হতাশাব্যাঞ্জক। এটি এই সময়কার বহুল আলোচিত একটি মামলাই শুধু নয়, কলঙ্কিত মামলাগুলোর মধ্যে একটি। যেভাবে এ মামলার ঘটনাগুলো ঘটেছে, পরবর্তী সময়ে তার যে বিবরণ আমরা পেয়েছি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টালবাহানা, ভুক্তভোগীদের হয়রানি, চিকিৎসকদের ভূমিকা, সর্বোপরি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের প্রভাব—নানা ঘটনা আছে। তাতে এ মামলার প্রথম থেকেই সবার মনে এ শঙ্কা তৈরি করেছিল যে এ ধরনেরই একটি রায় আসতে পারে। আমাদের সেই শঙ্কাকেই সত্য প্রমাণ করে এমন একটি রায় পাওয়া গেল, যা আমাদের বিচারব্যবস্থার প্রতি এখনো যতটুকু আস্থা রাখার চেষ্টা করি আমরা, তার ওপর কঠিন আঘাত হানল। এ রায় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: রায় ঘোষণার সময় আদালত নির্দেশনা দিয়েছেন, ধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে পুলিশ যেন মামলা না নেয়। এ বিষয়ে কী বলবেন, কতটুকু সংগত এ নির্দেশনা?

সুলতানা কামাল: নির্দেশনাটি কোনো বিচারেই সংগত হয়েছে বলা যায় না। প্রথমত, ফৌজদারি অপরাধের বিরুদ্ধে মামলা করার কোনো সময়সীমা আমাদের প্রচলিত আইনব্যবস্থায় বেঁধে দেওয়া নেই। বিচারকের এ নির্দেশনা সম্পূর্ণ বেআইনি। ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে ধর্ষণের আলামত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়, সে কারণে এই সময়সীমা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা যত উন্নত প্রযুক্তির দিকে এগোচ্ছি, অপরাধ নির্ণয়ে নানা সুযোগ আমাদের সামনে উন্মুক্ত হচ্ছে। ধর্ষণের মামলায় ডিএনএ পরীক্ষা তেমন একটি উপায়। অপরাধ যাতে প্রমাণ করা যায়, সে বিষয়ের ওপর জোর না দিয়ে বিচারক ৭২ ঘণ্টার পরে মামলা না নেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে ধর্ষণের শিকার মানুষের বিচার পাওয়ার পথে কঠিন অন্তরায় সৃষ্টি করলেন। আর একটি কথা, ধর্ষক বা ধর্ষকেরা ভুক্তভোগীকে ৭২ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখতে পারলেই নিজেদের বিচারের আওতামুক্ত থাকা নিশ্চিত করে নিতে পারল। আমার প্রশ্ন, মাননীয় আদালত একবারও এ মামলার বিচার করতে গিয়ে ভুক্তভোগীকে ন্যায়বিচার দেওয়ার কথা চিন্তা করে বিচারকার্য সমাধা করলেন কি? আদালতের এ নির্দেশনা ন্যায়বিচার প্রাপ্তির সম্ভাবনার মূলেই কুঠারাঘাত করেছে। এ নির্দেশনার ফলে সমগ্র বিচারব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে, নতুন করে আস্থার সংকট ঘটানো হয়েছে। ১৯৯৯ (স্মৃতি কণার মামলায় বিচারপতি বদরুল হক বাচ্চুর রায়) এবং ২০১৬ (একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের রায়) সালে দুটি রায়ে ভুক্তভোগীর বক্তব্য পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশ রয়েছে। এ আদালত তা সরাসরি অমান্য করেছেন। নারী নির্যাতন রোধে একটি বড় পদক্ষেপকে এখানে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আমাদের দেশের বাস্তবতায় অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার নারীর আইনি প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। এখন যখন আদালত একটি সময় নির্ধারণ করে দিলেন, তখন এ জটিলতা আরও কি বাড়ল না? ন্যায়বিচারের দৃষ্টিতে এ পর্যবেক্ষণ কতটুকু সংগত?

সুলতানা কামাল: আগেই বলেছি, এ পর্যবেক্ষণ ন্যায়বিচারের সব ন্যায়নীতির পরিপন্থী। একটি মানবিক সমাজ, যে সমাজে স্বাধীন, সৎ, নিরপেক্ষ এবং দুর্নীতিমুক্ত বিচারব্যবস্থা একটি অন্যতম প্রধান শর্ত; সেখানে কোনো বিচারকের কাছ থেকে এমন পর্যবেক্ষণ গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: মামলার রায়ে তদন্তের দুর্বলের বিষয়টিও উঠে এসেছে। তদন্তের ক্ষেত্রে গাফিলতির অভিযোগ আসে প্রায়ই। গাফিলতির অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে আসে, পরবর্তী সময়ে এ ব্যাপারে কতটুকু জবাবদিহির ব্যবস্থা আছে?

সুলতানা কামাল: তদন্তের দুর্বলতার শাস্তি স্পষ্টতই আদালত বিচারপ্রার্থীর ওপর চাপিয়ে দিলেন। যেটা শুধু অবিবেচনাপ্রসূত যে তা–ই নয়, অন্যায় এবং বিচারপ্রার্থীর বিচার চাওয়ার অধিকারকে খর্ব ও ক্ষুণ্ন করার শামিল। এখানে আবার তদন্তের আদেশ দেওয়া যেত। এখান তা না করে ভুক্তভোগীদের দোষারোপ করার মানসিকতাই প্রতিষ্ঠিত হলো। যা খুবই দুঃখজনক।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: অপরাধ করেও নিষ্কৃতি পেয়ে যাওয়ার ঘটনা আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত ঘটে। মানবাধিকারকর্মীরা একে ‘সংস্কৃতির অংশ’ বলে অনেক সময় ব্যাখ্যা করেন। নারীর প্রতি নিগ্রহের ক্ষেত্রে এই সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা কতটুকু দেখছেন?

সুলতানা কামাল: শুধু ধারাবাহিকতা নয়, এই আদালত নানা পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে অপরাধ করে নিষ্কৃতি পাওয়ার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। নারী নির্যাতনের যে প্রকট রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি, আদালতের এ পর্যবেক্ষণ তা বহুমাত্রায় উৎসাহিত করল। আমি আশা করব নাগরিক সমাজ, অধিকার আন্দোলনকর্মীরা; সর্বোপরি বিচারব্যবস্থাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ধরনের অপসংস্কৃতি রোধে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করবেন।