ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়ার কারণে অক্টোবর থেকে আটকে আছে উপকারভোগীদের ভাতা।
রাজধানীর কল্যাণপুরের উত্তর বিশিল বালুর মাঠ বস্তিতে থাকেন মমতাজ বেওয়া (৬৮)। চার বছর ধরে তিনি বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। তবে তাঁর এ ভাতা বন্ধ আছে গত ছয় মাস। একই রকম সমস্যায় পড়েছেন কল্যাণপুরের ১৬১/১১ দক্ষিণ পাইকপাড়ার বাসিন্দা আম্বিয়া খাতুন (৬৩)।
ওই এলাকার ৪৩০/২ বাড়ির বাসিন্দা পোশাককর্মী দম্পতির একমাত্র সন্তান রাব্বি ইসলাম (১৫) প্রতিবন্ধী ভাতা পায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে। তার ভাতাও বন্ধ রয়েছে বলে প্রথম আলোকে জানালেন মা ফাতেমা বেগম।
ভাতা কেন পাচ্ছেন না, খোঁজ নিতে ব্যাংকে গিয়েছিলেন তাঁরা। তবে যে ব্যাখ্যা পেয়েছেন, সেটা ততটা বুঝতে পারেননি। শুধু বুঝেছেন, ‘টাকা মাইর যাবে না।’
কেন তাঁরা ভাতা পাচ্ছেন না, জানতে সমাজসেবা অধিদপ্তরে খোঁজ নিলে জানা যায়, ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়ার কারণে ছয় মাস ধরে আটকে আছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগীদের ভাতা। ইতিমধ্যে ভাতাভোগীদের অর্ধেকসংখ্যকের ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট তৈরির কাজ শেষ হয়েছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি শাখা) ফরিদ আহমেদ মোল্লা প্রথম আলোকে বলেছেন, ৪৯৫টি ইউনিটে জিটুপি (গভর্নমেন্ট টু পারসন) পদ্ধতিতে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৮০-৯০ শতাংশের মতো ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট তৈরি হলেই ঈদুল ফিতরের আগে বকেয়া ভাতা একসঙ্গে দেওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ৭টি নতুনসহ ২০২০-২১ অর্থবছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১২৩টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চলছে। এতে বাজেট রয়েছে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা।
জানা গেছে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে ২০২০-২১ অর্থবছরের বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা ও প্রতিবন্ধী ভাতা কর্মসূচির অধীনে মোট ৮৮ লাখ ৫০ হাজার সুবিধাভোগীকে নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে এক লাখের মতো প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি রয়েছে। ইলেকট্রনিক উপায়ে জিটুপি পদ্ধতিতে ভাতা পৌঁছানোর লক্ষ্যে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) সফটওয়্যার ব্যবহার করে উপকারভোগীদের ডেটাবেইস তৈরি করা হচ্ছে। মোবাইল ফোনে অর্থ লেনদেন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে দেশজুড়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে। অ্যাকাউন্টধারীদের সব তথ্য এমআইএসে ডেটাবেইস আকারে থাকবে।
বিকাশের করপোরেট যোগাযোগ বিভাগের প্রধান শামসুদ্দিন হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আমাদের কাছে যে মোবাইল ফোন নম্বরগুলো পাঠানো হয়েছে, সেগুলোর তথ্য জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছে বিকাশ। একই নম্বর যেন একাধিক ভাতা কর্মসূচিতে না থাকে, সেটাও দেখতে বলা হয়েছে বিকাশকে। যেসব নম্বরে বিকাশ অ্যাকাউন্ট নেই, সেগুলো বিকাশ করা হচ্ছে। আর যেগুলোতে ইতিমধ্যে বিকাশ রয়েছে, সেগুলো সেভাবেই রাখা হচ্ছে।
বিধবা মমতাজ বেওয়া তাঁর ছেলে পোশাককর্মী সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে বস্তিতে থাকেন। মা ও ছেলে এই প্রতিবেদককে জানান, কেন ভাতা পাচ্ছেন না, সেটা তাঁরা জানতেন না। গত মাসে আঙুলের ছাপ নেওয়া হয় তাঁর। সেই সঙ্গে একটি নতুন সিম কার্ড দেওয়া হয়। তাঁর নিজের ফোন নেই। ছেলের ফোনে দুটি সিম ভরা যায়।
সমাজসেবা অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) মাধ্যমে প্রায় ৭৬ লাখ ভাতাভোগীকে ভাতা দেওয়া হবে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত এমআইএসে অন্তর্ভুক্ত উপকারভোগীদের মধ্যে প্রায় ৪৫ লাখের মোবাইল ব্যাংকিং বা ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে।
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তমাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর উপজেলায় ১২ হাজার ৬৮৭ জন প্রতিবন্ধী, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা এবং মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন। এর মধ্যে ১২ হাজার ১০৮ জনের এমআইএস ডেটাবেইস হয়েছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছর থেকে সোনালী, অগ্রণী, জনতা, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মাধ্যমে ভাতার টাকা দেওয়া শুরু হয়। ৪৯৫টি উপজেলা এবং মহানগর ও জেলা শহরে সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন ৮০টি আরবান কমিউনিটি ডেভেলপমেন্টের (ইউসিডি) ইউনিটের মাধ্যমে ভাতার টাকা দেওয়া হয়।
২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ২১টি জেলার ৭৭টি উপজেলার সাড়ে ১২ লাখের মতো বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা এবং প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীকে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে ভাতা দেওয়া শুরু হয়। ব্যাংক এশিয়া, মধুমতি ব্যাংক লিমিটেড ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চুক্তিবদ্ধ উদ্যোক্তারা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে (ইউডিসি) ভাতা বিতরণ করেন।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি শাখা) ফরিদ আহমেদ মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ডিজিটাইজড অ্যাকাউন্ট হওয়ার কারণে ভাতাভোগীদের যে কেউ যেকোনো স্থান থেকে নগদ ও বিকাশ এজেন্ট বা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ভাতার টাকা তুলতে পারবেন। নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারের সঙ্গে ভাতাভোগীদের তথ্য মিলিয়ে এমআইএসে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। কত বাদ পড়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে সে তথ্য নেই। তবে খুব সামান্যই বাদ পড়েছেন। বাদ পড়া ব্যক্তিদের জায়গায় অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে ভাতাভোগী নেওয়া হচ্ছে।
কল্যাণপুর ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে জানান, ডিজিটাইজেশনের কারণে গত ২৪ মার্চ স্থানীয় একটি স্কুলমাঠে সমাজসেবা অধিদপ্তরের তালিকা অনুসারে ফোন করে ভাতাভোগীদের বিভিন্ন সময়ে ডেকে আনা হয়। ৩১৩ জন বয়স্ক, ২১৬ জন প্রতিবন্ধীসহ মোট ৫২৯ এমআইএসভুক্ত হয়েছেন, তাঁদের নগদ অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। তিনি জানান, তাঁদের আগের তালিকায় ৭৫০ জনের মতো ছিল। সেখানে থেকে ৩০ শতাংশ বাদ পড়েছেন। কেন বাদ পড়েছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের সামনের অংশের সঙ্গে অন্য কারও জাতীয় পরিচয়পত্রের পেছনের অংশ ফটোকপি করে জমা দিয়ে একাধিক এলাকায় ভাতার তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন। জাতীয় পরিচয়পত্র সার্ভারের সঙ্গে তথ্য মেলাতে গিয়ে এসব জালিয়াতি ধরা পড়েছে। নতুন করে ২২৫ জনকে তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে।
গত ২০ জুলাই জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের (এনএসএসএস) মধ্যবর্তী পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, তালিকাভুক্ত ভাতাভোগীদের ৪৬ শতাংশের বেশি ভাতা পাওয়ার যোগ্য নন।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক কে এ এম মোর্শেদের মতে, ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে তিন ধরনের অনিয়ম হয়ে থাকে। যাঁদের ভাতা প্রয়োজন নেই, তাঁদের তালিকাভুক্ত করা; যাঁদের প্রয়োজন আছে, তাঁদের তালিকার বাইরে রাখা এবং ভাতাভোগীদের অর্থ থেকে স্থানীয় পর্যায়ে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের একটা অংশ রেখে দেওয়া। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনিয়ম কতটা দূর হবে, তা বলা যাচ্ছে না। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এ পদক্ষেপ ইতিবাচক। করোনাকালে গত বছর ঈদের সময় প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ৫০ লাখ লোককে মোবাইলের মাধ্যমে অর্থসহায়তা পৌঁছানো হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতাভোগীদের অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে ডিজিটাইজেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কে এ এম মোর্শেদ বলেন, চাইলে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর সহায়তায় মোবাইল ব্যাংকিং পদ্ধতি থেকে উপকারভোগী তালিকাভুক্তির অনিয়ম ঠেকানো যেতে পারে। একজন ভাতাভোগী মুঠোফোনে কথা বলতে গিয়ে কত টাকা খরচ করছেন, সেটা এক বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই বের করা সম্ভব কার ভাতা দরকার, কার নেই।