৬ ট্যুরিস্ট বাস কিনতে গলদ, খরচা আরও ৮ কোটি

প্রতীকী ছবি

ইউরোপ থেকে কেনার কথা ছিল ছয়টি ট্যুরিস্ট বাস। তবে গত দেড় বছরে বাস আমদানিতে দরপত্রই আহ্বান করতে পারেনি বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন (বাপক)। দেশের সীমানায় ট্যুরিস্ট বাস না ঢুকলেও উল্টো কেনার খরচ বেড়েছে ৮ কোটি টাকা।

২০২০ সালের নভেম্বরে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে বাস কেনার প্রকল্পটি অনুমোদন করে বাপক। এ ধরনের প্রকল্প বাপকের জন্য প্রথম। সাধারণত নতুন কোনো ক্রয় প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা রয়েছে—এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মতামত নেওয়া হয়।  বাপকের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, প্রথমবারের মতো দোতলা ট্যুুরিস্ট বাস আনতে বিভিন্ন মহল থেকে মতামত নেওয়া হয়নি। এ কারণে নানা ভুল ধরা পড়ে। এসব ভুল শোধরাতে গিয়ে ১৯ কোটি টাকার ৬টি বাস কেনার প্রকল্পের খরচ গিয়ে ঠেকেছে ২৭ কোটি টাকায়। অর্থাৎ খরচ বেড়েছে ৮ কোটি টাকা।

পরিকল্পনা কমিশন বলছে, ভ্রমণপিপাসুদের জন্য মাত্র ছয়টি বাস কেনা বর্তমান সময়ে ছোট একটি প্রকল্প। এত ছোট একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পরিকল্পনার ঘাটতি ও এত অব্যবস্থাপনা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এত সময় লাগারও কথা নয়। অবশ্য পর্যটন করপোরেশন বলছে, গোড়ার গলদ দূর করে তারা এখন বাস আনতে প্রস্তুত।

গলদ কোথায়

পর্যটকদের দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখাতে ইউরোপ থেকে ট্যুরিস্ট বাস কেনার প্রক্রিয়াটি শুরু হয় ২০২০ সালে। তখন বাপকের পরিকল্পনায় ছিল, ট্যুরিস্ট বাসগুলো হবে ছাদখোলা। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) বাসে রাখা হয়েছিল টয়লেট–সুবিধা। তবে খাবার গরম করার জন্য প্যান্ট্রি–সুবিধা রাখা হয়নি। হুইলচেয়ারের মাধ্যমে গাড়িতে ওঠার ব্যবস্থাও রাখা ছিল না। বাসগুলো কোথায় রাখা হবে, সে কথাও ভাবেনি বাপক। তাই শেড নির্মাণের কোনো পরিকল্পনা করেনি বাপক।

বাপকের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়, বাস আমদানির প্রক্রিয়া চালাতে গিয়ে তারা বুঝতে পেরেছে, পুরোপুরি ছাদখোলা বাস বাংলাদেশের জন্য উপযোগী নয়। কারণ বাংলাদেশের আবহাওয়া ইউরোপের মতো নয়। এখানে ছয় মাস বর্ষাকাল। অন্য সময় প্রচণ্ড রোদ থাকে।

বাসে টয়লেট–সুবিধা না রাখার কথা বলেছি। কারণ, এসি বাসে টয়লেট থাকলে এর ব্যবস্থাপনা করা কঠিন হবে। তখন বাসে দুর্গন্ধ ছড়াবে। বাংলাদেশের আবহাওয়ার কথা বিবেচনা করে আমরা ছাদখোলা বাস আনতে নিষেধ করেছি।
শরীফা খান, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব)

পরিকল্পনা কমিশনও বলছে, বর্ষা ও রোদ থেকে রক্ষা পেতে পুরো বাস ছাদ খোলা রাখা উচিত হবে না। এখন প্রকল্পটি সংশোধন করে বৃষ্টি ও গরমের সময় যাতে ছাদ বন্ধ রাখা যায়, আবার খোলা যায়, সে ব্যবস্থা রেখে কাস্টমাইজড বাস আমদানি করা হবে।

এ ছাড়া বাসের ভেতরের পরিবেশ ঠিক রাখতে টয়লেট–সুবিধা বাদ দেওয়া হচ্ছে। খাবার গরমের জন্য নতুন করে প্যান্ট্রি–সুবিধা রাখা হচ্ছে। হুইলচেয়ারের মাধ্যমে গাড়িতে ওঠার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) শরীফা খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা দেশে মহাসড়কে চালকদের বিশ্রামের সার্ভিস সেন্টার নির্মাণ করা হচ্ছে। তাই বাসের ভেতর টয়লেট–সুবিধা না রাখার কথা বলেছি আমরা। কারণ, এসিযুক্ত বাসে টয়লেটের ব্যবস্থা রাখলে এর ব্যবস্থাপনা করা কঠিন হবে। তখন বাসে দুর্গন্ধ ছড়াবে। বাংলাদেশের আবহাওয়ার কথা বিবেচনা করে আমরা ছাদখোলা বাস আনতে নিষেধ করেছি। বাসে প্যান্ট্রির ব্যবস্থা আগে ছিল না। আমরা নতুন করে এ ব্যবস্থা যোগ করেছি।’

প্রকল্পের প্রস্তাবনা বলছে, পরীক্ষামূলকভাবে আমদানি করা ছয়টি ট্যুরিস্ট বাসের মধ্যে দুটি চলবে ঢাকা বিভাগের আকর্ষণীয় বিভিন্ন পর্যটন এলাকায়। দুটি বাস চলবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার পর্যটন এলাকায়। আর বাকি দুটি বাস চলবে সিলেট বিভাগের চারটি জেলায়। এসব বাস দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হলে আরও বাস আনা হবে বলে জানিয়েছেন বাপকের কর্মকর্তারা।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় বলছে, দেশের পর্যটনশিল্পকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য এবারই প্রথম এসব ট্যুরিস্ট বাস কিনতে যাচ্ছে সরকার। ছয়টি বাস কিনতে প্রথমে সম্ভাব্য খরচ ধরা হয়েছিল ১৯ কোটি টাকা। তখন প্রতিটি বাসের দাম ধরা হয়েছিল সোয়া তিন কোটি টাকা। প্রতি বাসে আসন থাকবে ৪০ থেকে ৪৫ জনের। বাসে থাকবে ওয়াই-ফাইয়ের ব্যবস্থা। সংশোধন করার পর এখন প্রতিটি বাস আমদানিতে খরচ পড়বে সোয়া চার কোটি টাকা।

ওই মন্ত্রণালয় আরও বলছে, প্রকল্পটি প্রথম অনুমোদনের সময় কোচগুলো রাখার জন্য শেড নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল না। সংশোধনীতে ছয়টি গাড়ির জন্য চারটি স্থানে ঢাকা, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া, সিলেট ও কক্সবাজারে চারটি শেড নির্মাণ করা হবে। সে জন্য খরচ হবে দুই কোটি টাকা। চালক, সহকারী ও গাইডদের প্রশিক্ষণ, তথ্যচিত্র তৈরি, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্যাকেজ ট্যুরের বিজ্ঞাপন, লিফলেট, স্যুভেনির তৈরিতে খরচ হবে আরও এক কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ কোটিতে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে।

এই প্রকল্পের পরিচালক এহসানুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকল্পে নতুন করে বেশ কিছু বিষয় যুক্ত হয়েছে। সে কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে। এটি অনুমোদন পেলে আমরা দরপত্র আহ্বান করব। আশা করছি এবার প্রকল্পে গতি আসবে।’

গাড়ি আমদানির পর এর রক্ষণাবেক্ষণ কীভাবে হবেম তা জানতে চাইলে এহসানুল কবীর বলেন, বিদেশি কোম্পানিগুলোর এ দেশে এজেন্ট আছে। সার্ভিস সেন্টার যার বেশি, দরপত্র মূল্যায়নের সময় ওই কোম্পানিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। সংশোধিত প্রকল্পটি কাস্টমাইজড করে আমদানি করা হবে বলে জানান তিনি।

বেসরকারি উদ্যোগে গত বছরের শুরুতে প্রথমবারের মতো একটি ছাদখোলা বাস চালু হয়েছে কক্সবাজারে। ৪৮ আসনবিশিষ্ট দ্বিতল বাসটি সকাল নয়টায় কক্সবাজারের কলাতলী থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে টেকনাফ পর্যন্ত চলাচল করছে। সরকারিভাবে এবারই প্রথম পর্যটকদের জন্য দ্বিতল বাস কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।