অর্থনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক ও উন্নয়নকর্মীরা মনে করেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে দাঁড়িয়েও বাংলাদেশের সামনে এখনো বড় সংকট গণতন্ত্র পুনর্গঠন, মতপ্রকাশে বাধা ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা।
অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেছেন, ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো কার্যকর নির্বাচনব্যবস্থা তৈরি করা যায়নি। আর বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো রওনক জাহান মনে করেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো আইন দিয়ে সংবাদমাধ্যমকে শৃঙ্খলিত করার ঘটনা উদ্বেগজনক এবং এমন আইন প্রত্যাহার করা প্রয়োজন।
‘৫০ বছরে বাংলাদেশ: ফিরে দেখা ও ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট ও মিত্তাল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে অনলাইনে দুই দিনের সম্মেলনের প্রথম দিন গতকাল বুধবার বক্তাদের আলোচনায় এসব মত উঠে আসে।
সম্মেলনে মূলত বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং বর্তমান সময় ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোকপাত করা হয়। আলোচনায় দেশের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও মানবিক উন্নয়ন এবং দেশের অগ্রগতিতে সুশীল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
বুধবার সম্মেলনের প্রথম পর্বের আলোচনা ছিল সংবিধানের চার মূলনীতিকে ঘিরে। এই পর্বের আলোচক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান এবং রওনক জাহানের উদ্দেশে মডারেটর প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির গ্যারি বাসের প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশের চার মূলনীতির প্রণয়নের প্রক্রিয়া এবং কীভাবে খুব দ্রুত তা গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করল?
রওনক জাহান বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় দেশের স্থিতিশীলতার বিষয়ে অনেকের মনে সন্দেহ ছিল, বিশেষ করে দেশের বাইরে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল, কয়েক মাসের মধ্যে দেশ স্থিতিশীলতা অর্জন করল। সেই সঙ্গে দেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মধ্যে দেশের সংবিধান রচিত হয় এবং চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে সামনে নিয়ে এগোতে থাকে।
২০০৮–এর নির্বাচনের পর সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হয়নি উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান তাঁর বক্তব্যে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রসঙ্গে বলেন, গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় বাংলাদেশ শুরু থেকে কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে আছে। আর সমাজতন্ত্রের কথা বলতে গেলে বলতে হবে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন, যেন এলিট শ্রেণি দরিদ্রদের শোষণ করতে না পারে। কিন্তু যেদিন জাতির জনককে হত্যা করা হলো, সেদিন থেকেই সমাজতন্ত্রের অবসান হয়েছে।
রেহমান সোবহান বলেন, আশির দশকের শুরুতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা এবং নিহত জেনারেলের স্ত্রীর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভাবা হয়েছিল, একটি গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের সূত্রপাত হলো কি না! এরশাদ সরকারের পতনের পর মনে করা হয়েছিল, দ্বিতীয় যুদ্ধজয়।
রেহমান সোবহান বলেন, ১৯৯১ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আমিও তার সদস্য ছিলাম। এর একটি বড় অর্জন ছিল সংসদীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন ও মুক্ত অবাধ নির্বাচন। সে নির্বাচনকে দারুণ প্রতিশ্রুতিশীল মনে করা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের অন্য আরও অনেক কিছুর মতো শুরুটা যেমন, শেষটা সে রকম হয়নি। সেখানে যে আশাবাদ ছিল, দুঃখজনক হলেও সত্যি তা আর হয়নি।
সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা বিশাল চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন তিনি। আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল যে মুখোমুখি অবস্থানে পৌঁছেছে, অনেকটা যেন তাদের বিরোধ হুতু আর তুতসিদের মতো। এটা সংসদীয় ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং এটা একটা গুরুতর চ্যালেঞ্জ।
তবে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও দেশে চারটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে মনে করেন রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ সালের নির্বাচন এবং ২০০৮ সালের সেনা–সমর্থিত সরকারের অধীনে নির্বাচন ছিল সর্বশেষ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এই নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এরপর যেসব নির্বাচন হয়েছিল, সেগুলোকে বলা যায়, নন-ইলেকশন। কারণ, সেসব অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছিল না, সেখানে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
রেহমান সোবহান আরও বলেন, ৫০ বছর চলে গেছে, একটি কার্যকর নির্বাচনব্যবস্থা গঠন করা যায়নি। সংসদও অকার্যকর, যেখানে কারও জবাবদিহির ব্যাপার নেই।
রেহমান সোবহান তাঁর বক্তৃতায় সংসদে ব্যবসায়িক শ্রেণির আধিপত্যের কথাও তুলে ধরেন। তিনি এ–ও বলেন, সংসদ সদস্যরা তাঁদের অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে সাংসদ পদ ব্যবহার করেন এবং তাঁরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া এলিট শ্রেণি ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ না করার রীতি চালু করেছে। তিনি বলেন, পুঁজিবাদের অর্থনীতি থেকে এলিট শ্রেণি সুবিধা পেয়েছে। তারা প্রচুর অর্থসম্পদ স্থানান্তর করেছে।
সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন প্রসঙ্গে সিপিডির চেয়ারম্যান বলেন, এর জন্য কোনো টেকনিক্যাল বিষয় দরকার, তা নয়। কারণ, এটা বাস্তবায়ন করার বিষয়। তা নির্ভর করে রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকদের ওপর। তাঁর মতে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে। নতুন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। পুরোনো বা সাবেকি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দিয়ে এখন চালানো সম্ভব নয়।
গণতান্ত্রিক ও সিস্টেমেটিক গণতন্ত্রের জন্য কী দরকার? গ্যারি বাসের এমন প্রশ্নের জবাবে রওনক জাহান গণতন্ত্র পুনর্গঠনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ, তা নয়, প্রতিবেশী ভারত, কিংবা যুক্তরাষ্ট্রেও আমরা একে বিশাল চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছি।’
রওনক জাহান মনে করেন, সবার আগে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। এ সময় তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, গণমাধ্যম যে ভূমিকা পালন করছিল, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনসহ অন্যান্য কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল। সুশীল সমাজও নিজেদের মতামত প্রকাশ করে যাচ্ছিল। কিন্তু সরকার এমন কিছু আইন করেছে, যার মাধ্যমে তারা মিডিয়াকে শৃঙ্খলিত করতে চায়।
বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় অনেকে উদ্বিগ্ন বলে উল্লেখ করেন রওনক জাহান। মানবাধিকার কমিশনকে আরও সক্রিয় করা দরকার, যা সাধারণ মানুষও চায়।
সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্বে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গ্রামীণ কৃষি, প্রবাসী আয়, পোশাকশিল্প ও বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের কথা উঠে আসে।
গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, একটা সময় বাংলাদেশকে দুর্যোগের শিকার ভুক্তভোগী মনে করা হতো। সে অবস্থান থেকে দেশ এখন দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম হয়েছে। তিনি মনে করেন, বিনিয়োগ ও সুশাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চীনের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লিংকন চেনের সঞ্চালনায় এই পর্বে আলোচনায় আশির দশকে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সফলতার কথা উঠে আসে। এর মাধ্যমে জন্মহার কমায় নারীদের কাজের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা এসেছে বলে উল্লেখ করা হয়।
পপুলেশন কাউন্সিলের সাজেদা আমিন বলেন, আশির দশকে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির ফলাফল খুব ইতিবাচক ছিল। তবে নব্বইয়ের দশক ছিল খুব জটিল। সে সময় শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। নারীশিক্ষাকে জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাঁর মতে, বড় সমস্যা মেয়েদের ওপর যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা। এ ছাড়া এশিয়াজুড়ে প্রকট বাল্যবিবাহ সমস্যা বাংলাদেশে এখনো আছে। সেদিকে নিরাপত্তা বিধানের কথাও ভাবার ওপর জোর দেন তিনি।
ইয়েল ইউনিভার্সিটির আহমেদ মুশফিক মোবারক বলেন, সরকার ছাড়াও বেসরকারি বিভিন্ন এনজিও দেশের অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখেছে। কৃষির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, উৎপাদনব্যবস্থা ভালো থাকায় খাদ্যসংকট দেখা যায়নি।
আইএমএফের পক্ষে ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে প্রবাসী আয়, তৈরি পোশাকশিল্প ও কৃষি খাত যে ভূমিকা রেখেছে, ৫০ বছর পর আমরা নতুন কী করতে পেরেছি? তাঁর মতে, পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হবে নতুন বৈচিত্র্য বের করে আনা।’
সম্মেলনের তৃতীয় ও শেষ পর্বে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার বিষয়গুলো উঠে আসে। ওরস্যালাইনের মাধ্যমে ডায়রিয়া মোকাবিলা, শিক্ষার হার বৃদ্ধির বিষয় ইতিবাচকভাবে উঠে এলেও এই দুই খাতের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আলোচকেরা।
এই পর্বে আলোচনার সমন্বয় করেন হার্ভার্ড টিএইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথের রিচার্ড ক্যাশ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দীন মাহমুদ বলেন, শিক্ষা খাতে সার্বিকভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি একটি সমস্যা। প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা মূলত সরকারি হওয়ায় নজরদারি রয়েছে। কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থার নিয়োগপ্রক্রিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব থাকে, যা শিক্ষার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ওয়াহিদউদ্দীন মাহমুদ আরও বলেন, কম মজুরি দেওয়া হয় যেসব খাতে (পোশাক, অদক্ষ প্রবাসী শ্রমিক), সেগুলোতে দেশ উন্নতি করেছে। কিন্তু এখন নজর দিতে হবে প্রযুক্তিভিত্তিক অন্যান্য খাতের দিকে।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন মনে করেন, প্রাথমিক শিক্ষার পরের ধাপে যে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তা কী কাজে আসছে, জানা নেই। শিক্ষকদের জবাবদিহি ও শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে পারছে না স্কুল কমিটিগুলো।
ওয়াটারএইডের আঞ্চলিক প্রতিনিধি খায়রুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি পর্যায়ের ব্যর্থতার বিষয়টি করোনার সময়ে নজরে এসেছে। বেসরকারি হাসপাতাল চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে অপারগতা জানালে পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের রওনক জাহান গণতন্ত্র নিয়ে তাঁর বক্তব্যের একপর্যায়ে বলেন, ‘২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে রাজপথে শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন হয়েছিল, সেই আন্দোলন দেখে বুঝতে পেরেছি, আশা হারানো উচিত হবে না।’